সিলেটে ৫৫ বছরের পুরনো হাটের জমি অন্য সংস্থাকে ভবনের জন্য লিজ প্রদান!
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ৫:৩৮:৫৮ অপরাহ্ন
হাটের জমি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেয়া যায় না: আইনজীবী
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রয়োজনে বাজার রক্ষা করা হবে : মেয়র
আহমাদ সেলিম :
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার হবিনন্দী কুশিঘাট এলাকার ৫৫ বছরের পুরনো একটি হাটের নাম সাহেববাজার। যেটি ১৯৬৮ সাল থেকে হাটবাজার হিসেবেই গণ্য হয়ে আসছে। বছরের পর বছর ইজারা প্রক্রিয়ায় চলমান সেই হাটের জায়গাটি বর্তমানে ভবন নির্মাণের জন্য লিজ দেয়া হয়ে গেছে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড নামে একটি সংস্থাকে। হাটের ভূমি অন্য একটি সংস্থাকে লিজ দেয়ায় হাটের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা হতবাক।
লিজ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড সিলেট বিভাগীয় অফিস বলছে, তারা দশহাজার টাকা মূল্যে সিলেটের সাবেক জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদী লিজ নিয়েছেন ভবন নির্মাণ করার জন্য। এ ব্যাপারে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ইইউ শহীদুল ইসলাম শাহীন জানান, হাটের জায়গা কোনোভাবেই যেমন স্থায়ীভাবে বিক্রি করা যায়না, তেমনি হাট ব্যতিত অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেয়ার ব্যাপারে আইনের নিষেধ রয়েছে। এ ছাড়া, লিজ দীর্ঘমেয়াদীও হয়না।
হাটটির অবস্থান দক্ষিণ সুরমার হবিনন্দি মৌজায়। সেই মৌজা অনুযায়ী হাটের দাগ নম্বর ৪২২, জে.এল নম্বর ১০৭, খতিয়ান ৭৪/০ এবং হাটের ভূমির পরিমাণ ২০ শতক।
সিলেট সদর উপজেলার প্রাচীন সেই বাজার নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১৯৬৮ সালে গোড়াপত্তন হয়। এক সময় দক্ষিণ সুরমার মধ্যে (সাবেক কুচাই ইউনিয়ন) সমৃদ্ধ হাট ছিলো এটি। বর্তমানে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৭. ৪০. ৪১ এবং ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের একমাত্র পুরনো বাজার হিসেবে গৌরব বহন করছে এই হাটটি।
কুশিঘাটে সুরমা নদী থেকে বিশ থেকে পঁচিশ গজ অদূরে এই বাজারের অবস্থান। একযুগ আগেও বিভিন্ন উপজেলা থেকে ব্যবসায়ীরা নৌকাযোগে এসে এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় তরিতরকারি, এমনকি মাছ নিয়েও বসতেন। সপ্তাহে তিনদিন, রোববার, মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবার বাজারটি বসতো। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন ব্যবসায়ী এখানে ব্যবসা করতেন। এদের বেশীরভাগই ছিলেন কুচাই এবং আশপাশ এলাকার বাসিন্দা। তিনদিনের হলেও এই বাজারের অন্তত পঞ্চান্ন বছরের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে সেই এলাকা থেকে বাজারের ইতিহাস মুছে দেওয়া, কোনোভাবেই যেন মেনে নিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। তাই সবার মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। সবাই ঐতিহ্যবাহী বাজারটি রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছেন, তারা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর শরণাপন্ন হয়েছেন।
জানা যায়, ১৯৬৮ সালে এলাকাবাসীর স্বার্থ বিবেচনা করে কুশিঘাটের বাসিন্দা ওয়াব আলী নামে এক ব্যক্তি হাটের জন্য নিজের বিশশতক জমি দান করেন। পরবর্তীতে সেই হাট সরকারের তালিকায় হাট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপর থেকে প্রতিবছর বাজার লিজ দেয়া হয় এবং সেই লিজের মাধ্যমে ব্যবসা চলে আসছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালের সাত ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদ থেকে হাটটি লিজ দেয়া হয়। সেই লিজ নেন স্থানীয় বাসিন্দা শামীম কবীর। কিন্তু ২০০৪ সালে বন্যার সময় বাজারের ভূমি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার পানির ¯্রােতে মাটি সরে গিয়ে বাজার নিচু হয়ে যায়। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা বেকায়দায় পড়েন। নিরূপায় হয়ে তারা বাজারটি সিলেট-জকিগঞ্জ মূল সড়কের উপর নিয়ে যান।
এ অবস্থায় পুরনো বাজারটি খালি অবস্থায় পড়ে থাকে এবং সেটি আবার নতুন করে জাগিয়ে তুলতে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সাথে কয়েক দফায় বৈঠকও করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এই প্রক্রিয়া চলমান অবস্থায় হঠাৎ করে সেখানে জমির মালিক হিসেবে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ কর্মচারি কল্যাণ বোর্ডের নামে।
কাগজ ঘেটে জানা যায়, ১৯৬৮ সালের একটি দলিলপত্রে জায়গার রকম যেভাবে ‘হাট’ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, এখনো সেই নামেই রয়ে গেছে। কিন্তু সম্প্রতি সেই হাটের উপর বসানো একটি সাইনবোর্ড অতীতের সব রেকর্ড যেন ওলট-পালট করে দিয়েছে। টাঙানো সাইনবোর্ডের উপর লেখা রয়েছে –
‘জমির মালিক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কর্মচারি কল্যাণ বোর্ড, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১ম ১২তলা সরকারি অফিস ভবন (১১তলা) সেগুনবাগিচা ঢাকা।’
এই লেখার নিচে একইভাবে রয়েছে “বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কার্যালয় সিলেট এর ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত স্থান। জমির পরিমাণ ০.২৮০৪ একর।”
১৯৬৮ সালে ওয়াব আলী হাটের জন্য যখন ভূমি দান করেন তখন ভূমির পরিমাণ ছিলো বিশ শতক। কিন্তু বর্তমানে যে সাইনবোর্ড ঝুলছে সেখানে ভূমির পরিমাণ হিসেবে ২৮ শতক হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ বাজারের বাইরে ব্যক্তি মালিকানাধীন আরো ৮ শতক ভূমি হাটের ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে গেছে। যার মালিকানা হিসেবে রয়েছেন স্থানীয় গুলজার আহমদ জগলু নামে এক ব্যক্তি।
হাটের সীমানার মধ্যে এই সাইনবোর্ড দেখে হাটের এক সময়ের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
বাজারটি রক্ষার জন্য সম্প্রতি সিলেটের বর্তমান জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান এর কাছেও ৩৭ জনের সই সম্বলিত একটি স্মারকলিপিটি দেয়া হয়েছে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে।
এই বাজারের একসময়ের ব্যবসায়ী পঞ্চাশোর্ধর শাহ আলম বলেন, ‘বাজারের জমি বাজার হিসেবে লিজ দেয়ার বিষয়টা আমরা জানি, কিন্তু সেটি ভবন নির্মাণের জন্য কেনো দেয়া হলো, সেটি আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। আমরা আমাদের বাজার ফিরে পেতে চাই।’
ময়না মিয়া নামে ৬৫ বছরের আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘সিলেটে এরকম বহু বাজার রয়েছে। কিন্তু এভাবে তো ভবনের জন্য কেউ লিজ দেয় না।’
স্থানীয় বাসিন্দা গুলজার আহমদ জগলু বলেন, ‘আমার বাপ-দাদার আমলের বাজার এটি। রাতের আঁধারে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে আমাদের ঐতিহ্য নষ্ট হতো দিবো না।’ তিনি বলেন, ‘হাটের জমির পরিমাণ বিশশতক। কিন্তু সাইনবোর্ডে ২৮ একর লিখে নতুন আরেক সমস্যা তৈরী করা হয়েছে।’
এব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আজম খান এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বাজারটা রক্ষা করা জরুরী। বন্যার পর বাজার সংস্কার না করায় বর্তমানে সড়কের উপর বসে বেচাকেনা করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সড়ক বড় করার পর ঢালাইয়ের কাজ শুরু হলে সেই ব্যবসায়ীদের সরিয়ে দেয়া হবে। তখন তারা কোথায় যাবে?
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের বিভাগীয় পরিচালক মো. আজমল হোসেন এর সাথে। তিনি জানান, ‘আমরা দীর্ঘমেয়াদি লিজ নিয়েছি ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে, সিলেটের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান এর মাধ্যমে।’ হাটের জমি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে লিজ দিতে বাধা-বাধ্যকতা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘এখানে অনেকদিন ধরে বাজার বসছে না।’
যোগাযোগ করা হলে সিলেটের বিশিষ্ট আইনজীবী ই ইউ শহীদুল ইসলাম শাহীন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘হাটের জমি হাটকেই লিজ দিতে হবে। সেটি খালি অবস্থায় পড়ে থাকলেও অন্য কোনো কাজে সেটি লিজ দেয়া যাবে না। অর্থাৎ যিনি যে উদ্দেশ্যে এই জমি দান করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য ব্যতিত অন্য কিছু করা যাবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘হাটের জমি দীর্ঘমেয়াদি লিজও হয়না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি দুদক তদন্ত করলে হয়তো আড়ালের ঘটনাটি বেরিয়ে আসতে পারে।’
এ প্রসঙ্গে কথা হয় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সাথে। তিনি জানান, বাজার কখনো অন্য প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেয়ার নিয়ম নেই। মেয়র হিসেবে বিষয়টা আমিও জানিনা, এলাকাবাসীর কাছ থেকে শুনে অবাক হয়েছি। তবে আমি বাজার রক্ষায় ব্যবস্থা নেবো। প্রয়োজনে সব কাগজপত্র হাতে আসার পর বাজারের জন্য পত্রিকায় টেন্ডার দিয়ে দিবো।’