আল আকসার মুক্তির স্বপ্ন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ১১:২৫:২৭ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
দুনিয়া ঘনিয়ে আসছে আমাদের দিকে। ধরিত্রী ঠেসে ধরছে একেবারে শেষ কোনটায়….। শেষপ্রান্তে ঠেকে গেলে যাবটা কোথায়? শেষ আসমানে ঠেকে গেলে পাখিগুলো উড়বে কোথায়? হয়ার গুভ দ্য বার্ডস ফ্লাই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই? ফিলিস্তিনিদের ক্রমেই কোনঠাসা হতে থাকা জীবনের অসহায়ত্বের এই কথাগুলো ফিলিস্তিনের চিরনির্বাসিত জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের দ্য আর্থ ইজ ক্লোজিং অন আস থেকে নেওয়া। এই কবিতার শিরোনামের শেষাংশ আফটার দ্য লাস্ট স্কাই বা ‘শেষ আসমানের পর’ নিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ লিখেছেন, ফিলিস্তিনি জীবন বিষয়ক বই ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই’। সেখানে লেখক বলেছেন, শেষ আসমানের পর আর কোন আসমান নাই। শেষ ভূখ-ের পর আর কোন ভূখ- নাই। তাই ফিলিস্তিনিদের আমৃত্যু লড়াই করা ছাড়া কোন গন্ত্যান্তর নাই। এই বাস্তবতার নিরিখে হামাস এর অভিযান, ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’ ভিমরোলের চাকে ঢিল মারা’। হামাসের এই হামলার উদ্দেশ্য মোটেও গোপন কিছু নয়। প্রথমত: এই হামলার মধ্য দিয়ে হামাস ইসরায়েলের দখলদারি উৎপীড়ন; অবৈধ বসতি এবং ফিলিস্তিনিদের তথা বিশ্ব মুসলিমের ধর্মীয় প্রতীক আল আকসা মসজিদকে অপবিত্র করার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। দ্বিতীয়ত: এই অঞ্চলে বর্ণবাদী শাসন জারি রাখা ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিরোধিতার একটি জোরালো বার্তা দিতে চেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অবৈধভাবে আরোপিত অবরোধ থেকে মুক্তি এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার জন্য মরণ কামড়।
ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কী অটোমান সা¤্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনসহ বেশির ভাগ জায়গা চলে যায় ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের দোসরা নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর ইহুদিবাদীদের লেখা পত্রে ফিলিস্তিনি ভূখ-ে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে প্যালেস্টাইন এলাকায় ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয় এবং বিপুল সংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে প্যালেস্টাইন এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখ-কে দ্বিখ-িত করা সংক্রান্ত ১৮১নং প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দ্বিখ-িত করার প্রস্তাব পাশ করে নিজেদের মাতৃভূমির ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করে। ফিলিস্তিনি ভূমি জোর করে দখল করে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন করার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠন চখঙ (পিএলও) প্রতিষ্ঠার পর প্রয়াত ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেছিল।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ৩৬০ বর্গকিলোমিটারের এই ছোট্ট ভূখ-টি ইসরায়েলের দখলে চলে যায়। ১৯৯৩ সালে ‘অসলো’ চুক্তির পর গাজায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সীমিত শাসন মেনে নেয় ইসরায়েল। ২০০৫ সালে গাজা থেকে ইহুদি বসতি পুরোপুরি গুটিয়ে নেয় ইসরায়েল। কিন্তু ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের নির্বাচনে হামাস জয়ী হলে তারা গাজা থেকে ফাতাহ ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে হঠিয়ে দেয়, কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই তকমা দিয়ে হামাসের জয় মেনে নিতে চায়নি। প্রকারান্তরে হামাস ও ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার নীতিতে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজার উপর জল-স্থল ও আকাশ অবরোধ আরোপ করে। যার পর খোলা আকাশের নিচে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারাগারে রূপান্তরিত হয় গাজা। জাতিসংঘ গাজার জন্য যে মানবিক ত্রাণ ও ঔষধপত্র দিতো তা নিতে হয় ইসরায়েলের মর্জির ‘উপর’। ১৬ বছর ধরে এই অবরোধের মধ্যে দুঃসহ ও অমানবিক জীবন যাপন করছে গাজাবাসী। এই ১৬ বছরে হামাসের সঙ্গে বেশ কয়েকবার ইসরায়েলি বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় হাজার হাজার গাজাবাসীর মৃত্যু হয়েছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধূলায় মিশে গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল। ধ্বংস করে দিয়েছে সুপেয় পানির উৎস। এহেন মানবেতর জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়েও মৃত্যু শ্রেয়। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস একান্ত বাধ্য হয়েই গাজা থেকে ইসরায়েলে অগ্নিবানের মতো রকেট হামলা করেছে। ফিলিস্তিনিরা বিশ্ব মোড়লদের বুঝিয়ে দিয়েছে তারা নিজেদের শক্তিতে অপমানের জবাব দিতে জানে।
পরিশেষে বলব, ন্যায় যুদ্ধ ইবাদত। কোরআন করিমে আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা বলেন, তোমাদের কী হলো? তোমরা কেন আল্লাহর পথে লড়াই করছ না? আর দুর্বল পুরুষ-অসহায় নারী ও নিরাশ্রয় শিশুরা আল্লাহর কাছে আর্তনাদ করছে- হে আমাদের রব। আমাদের এই জালিমদের কবল থেকে মুক্তি দিন এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাঠান। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ন্যায়ের পথে যারা তাদের বিজয় আল্লাহর সাহায্যে সুনিশ্চিত। কোরআন হাকিমে রয়েছে, আল্লাহর হুকুমে অনেক ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলের উপর বিজয় লাভ করেছে। মহান আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই আছেন। সুরা বাকারা, আয়াত-২৪৯।
লেখক : কলামিস্ট।