সেকেন্ড হোম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৩৮:৩৭ অপরাহ্ন
শিল্পী দাস
আজ থেকে ১০ বছর আগের একটা ছোট ঘটনা মনে পড়ল। একজন ভদ্রলোক সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বকাঝকা করতেন। এর কারণ ছাত্রছাত্রীরা চিৎকার চেচামেচি করত, দৌড়াদৌড়ি করত এমনকি উনার বাড়িতে গিয়ে কামরাঙা পেড়ে খেত। ভদ্রলোক আদো ঘুমে এসে শিক্ষার্থীদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন। কেন শিক্ষার্থীরা তাদের এখানে যায়। আমি প্রধান শিক্ষক উনাকে শান্ত করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের বকাঝকা দিলাম আর উনাদের এখানে না যাওয়ার জন্য বললাম। সাথে এও বলে দিলাম যদি কেউ যায় আমাকে বলবেন এসে। তবে উনি এতটা অবুঝ ছিলেন না সামনে এসে বলতেন সবাই ক্লাসে গিয়ে পড়ালেইত হয়। ছাত্ররা বের হতে পারে না। আমরা শিক্ষকরা কি করতাম, না পড়াইয়া উনি কেন অকথ্য ভাষায় বললেন সেটার বিচার কিভাবে করানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমরা শিক্ষকরা বিজয়ী হলাম। উনাকে বিচারের আওতায় আনলাম।এই হল আমাদের পেশাগত মূল্যবোধ!
মনে মনে ভাবতাম কেন শিক্ষার্থীরা মারামারি করে, কেন ছোটাছোটি করে, কেন টিফিনের সময় ছুটি নিয়ে চলে যেতে চায়, কেন মায়ের সাথে ডাক্তারের কাছে যাব বলে ছুটি নিয়ে চলে যায়,দাদী হসপিটালে দেখতে যাব,এই জায়গা গুলিতে কাজ করতে লাগলাম। প্রথমে আসি মারামারি প্রসঙ্গে, মারামারি করে বিচার নিয়ে আসলেই বিচার করে ফেলি। এতেও কাজ হয়না, তবে অনেকটা কমে আসে তাদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কারণে। আর টিফিন পিরিয়ডে ছুটি নিয়ে চলে যায় কয়েকজন শিক্ষার্থী এই চলে যাওয়াতে কেউ কেউ আমরা খুশি হই। এখানে মায়েদের বুঝানোর চেষ্টা শুরু করলাম টিফিন দেওয়ার জন্য। আর এদিকে শিক্ষকদেরও টিফিন নিয়ে আসার জন্য বলি। একজনকে একটা টিফিন বক্স গিফট করি। বছর ৩ পর সফলতা আসতে লাগল। যে শিক্ষক টিফিন আনেন তিনি স্কুল ছেড়ে যান না। যে শিক্ষার্থী টিফিন আনে সে অর্ধ দিবসে বাড়ি যেতে চায় না। যখন টিফিনের সময় শিক্ষার্থীরা নিজেরা টিফিন করে তখন কাজে কাজেই মারামারি হয় না। বিষয় গুলো সবারই জানা বিষয়।
এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে দেখা হল সত্যিকারের বিদ্যালয় প্রেমী প্রকৃত একজন মানুষের সাথে। যিনি প্রত্যেক কাজে সবার অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে/উপজেলায় কোন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হলে সেখানে প্রধান অতিথি ছাড়া অন্য সকল অতিথিবৃন্দকেও এক এক করে সকলেই শিক্ষার্থীর হাতে পুরস্কার তুলে দিতেন। মঞ্চে উঠে এই পুরস্কার দিতে পেরে আমার যেমন ভাল লেগেছে তেমনি অন্যদেরও ভাল লেগেছে। এই যে একটা পরিবর্তন এখন সবাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত রয়ে যান। শিক্ষকদের মিটিং হলে একটা গল্প বলতেন-মেয়েরা বিয়ের পর যখন বাবার বাড়ি নাইওর যায় তখন দেখবেন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে যায়। আর যখন বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যায় তখন দেখবেন বিকালের আগে রওনা হতে পারে না। আমরা শিক্ষকরা মিটিং এ যাওয়াটাকে মনে করব বাবার বাড়ি যাওয়া। শিক্ষকদের আরও বলতেন- বিদ্যালয়ে আপনারা আপনাদের ছোট খাট প্রয়োজনীয় জিনিস রাখবেন যেমন চিরুনী, আয়না, তোয়ালে, টিফিন, পানির বোতল। কারণ বিদ্যালয় হল আপনার ঝঊঈঙঘউ ঐঙগঊ। আপনি স্কুলে যাওয়ার সময় যখন কোন মুদির দোকানের সামনে দিয়ে হেটে যাবেন তখন যদি দেরীতে যান আপনার নিজের খারাপ লাগবে। আর যদি তাড়াতাড়ি যান তবে সবাই আপনার বাসা কোথায় জানতে চাইবে পজিটিভ প্রশ্ন করবে। এত দূর থেকে আসেন আপনার একটা পজিটিভ ইমেইজ তৈরী হবে। আস্তে আস্তে পুরো এলাকায় সেই পজিটিভ ইমেইজ ছড়িয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার খাতা দেখার জন্য হেড এক্সামিনার প্রত্যেক বিষয়ে একজন করে ছিল, সেই বিদ্যালয়প্রেমী ভদ্রলোক এসে বললেন, প্রত্যেক বিষয়ে দুইজন থাকলে কাজ তাড়াতাড়ি হবে। আমি সহ অনেক সাধারণ শিক্ষক অবাক হলেন। হলও তাই। আমাকে দেওয়া হল ধর্ম শিক্ষার হেড এক্সামিনার। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা কম ছিল। আমি প্রধান পরীক্ষক আর একজন নীরক্ষক ছিলেন। উনি আমার থেকে বেশি সম্মানী পেতেন। আমার মনে নেই। আমি পেতাম ৭২ টাকা। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। এমন কি আমাদের বিদ্যালয়েও আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা হতো। আমি বলতাম, সবাই টাকার জন্য কাজ করে আমি না হয় দেশের জন্য করি। আমি ভাবলাম কাজটা আমি ছেড়ে দিলে যিনি আসবেন তিনিও বিব্রতকর অবস্থায় পড়বেন এই ৭২ টাকার জন্য। আমি দেখলাম আমার মাঝে দেশপ্রেম আর পেশাগত মূল্যবোধ দুটোই আছে।
মহোদয়ের কথায় আমি আমাদের বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেক কাজে মহোদয়ের পথ অনুসরণ করি।
মহোদয় বলতেন, বিভিন্ন কাজ নিজে আগে করতে হয়, নিজে শিখতে হয়। আমরা মায়েরা যখন নিজের সন্তানকে কিছু শিখাতে যাই বিষয়টা তখন আমরা আগে শিখি। যেমন- শপথ বাক্য আপনার সন্তানকে শিখাবেন সেই শপথ বাক্য আগে আপনাকে নিজে শিখে নিতে হবে। অনেক মায়েরা আছেন সংসারের কাজ করতে করতে সন্তানকে বলেন শপথ বাক্য বল সন্তানও মায়ের সাথে সাথে হাটতে হাটতে শপথ বাক্য আওড়াতে থাকে। আমরা শিক্ষকদেরকেও ছাত্রছাত্রীর মত অনুশীলন করতে হয়। বিষয় গুলো সবার জানা। মহোদয় বলতেন, বিদ্যালয়ে যত বেশী অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা থাকবে,এলাকাবাসীদের সম্পৃক্ততা থাকবে ততবেশী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এগিয়ে যাবে। এরপর থেকেই আমি এবং আমার শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়কে ঝঊঈঙঘউ ঐঙগঊ মনে করি। এতক্ষণ যার কথা বললাম তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় উপজেলা শিক্ষা অফিসার জনাব জিয়া উদ্দিন মহোদয়।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, চান্দাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট।