ব্যয় বনাম মিতব্যয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৪০:৫৩ অপরাহ্ন
ইছমত হানিফা
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা যদি কোন ক্ষেত্রে চাহিদার চেয়ে বা প্রয়োজনের বেশি কিছু ব্যয় করে ফেলি তাহলে তা খারাপ। যেকোন ব্যাপারে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু খরচ করা উচিৎ। তাই জীবনে চলার পথে প্রতিটি ব্যায়াপারে আমাদের মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। মিতব্যয়ী শব্দের অর্থ পরিমাণমতো ব্যয় করা, হিসেবি। মিতব্যয়ী কিন্তু কৃপন নয়। আমরা যখন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ হাতে নেই, দাঁত ব্রাশ করার জন্য। তখন ব্রাশে আমদের পেস্ট যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু নিব। ব্রাশ করা শেষ হলে তবে কলের পানি ছাড়বো। সাবান ব্যবহার করে শুকনো জায়গায় রাখবো। তাহলে সাবান সহজে গলে যাবে না। আমরা সবচেয়ে বেশি নষ্ট করি পানি। অনেকে আছেন অনবরত কল ছেড়ে রেখে পানির কাজ করেন। এটা ঠিক নয়। যেমন বাসন ধোয়া, কাপড় কাচা, গোসল করার সময় প্রয়োজনমতো পানি ব্যবহার করি। এরপর খাবার খাওয়ার সময় অনেক সময় আমারা খাবার বেশি নিয়ে নেই, আর পরে খেতে পারিনা ফেলে দেই। এইটা সবচেয়ে খারাপ খাবার নষ্ট করা আমাদের উচিৎ নয়। যতটুকু খাব ঠিক ততটুকু নিবো। এরপর যারা স্কুলে পড়ালেখা করে লেখার জন্য যে খাতা আছে, অনেক সময় সেই খাতার পাতা দিয়ে নৌকা বানায় প্লেইন বানায়, এইটা করা উচিত নয়। অনেকে বিনা প্রয়োজনে ঘরের লাইট ফ্যান চালিয়ে রাখি। আর মাস শেষে ইলেকট্রিক বিল বেশি দিতে হয়। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে আয় বুঝে ব্যয় কর। আয় বা সম্পদের পরিমিত ব্যয়ের অভ্যাসই মিতব্যয়িতা। মিতব্যয়িতা একটি অসামান্য মানবীয় গুণ। জীবনে যে যত বেশি মিতব্যয়ী সে তত বেশি দুশ্চিন্তা মুক্ত।
সুন্দর এবং সফল জীবন গঠনের জন্য মিতব্যয়িতার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। মিতব্যয়িতা মানুষকে হিসেবি ও সৎসাহসী হতে সাহায্য করে। আয় ও সম্পদের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় ব্যতীত কখনোই সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জন করা যায় না। সম্পদ ও অর্থের সঞ্চয় মানুষ জীবনে যে পেশাই গ্রহণ করুক না কেন তার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে অর্থ উপার্জন। কারণ অর্থ ছাড়া জীবনে অভাব পূরণ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা যায় না। জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অর্থ ছাড়া চলে না। কিন্তু বিনা পরিশ্রমে এ অর্থ উপার্জন করা যায় না। অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষকে দিনরাত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। শ্রমিক, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, উকিল, মোক্তার, ব্যবসায়ী কেউ বিনাশ্রমে অর্থ উপার্জন করতে পারে না। মানুষের বিদ্যা শিক্ষা, কারিগরি দক্ষতা অর্জন সকল কিছুর উদ্দেশ্যই হচ্ছে অর্থ উপার্জন। কীভাবে বেশি অর্থ উপার্জন করা যায় এ নিয়ে মানুষের প্রচেষ্টা ও চিন্তার শেষ নেই। রাজা-উজির, মন্ত্রী-সেনাপতি থেকে দীন-দরিদ্র, ভিখারি সবারই লক্ষ্য অর্থ উপার্জন। অর্থাৎ ধনী-দরিদ্র সবার
মধ্যেই অর্থ উপার্জনের প্রবণতা বিদ্যমান। তবে অর্থ উপার্জনই বড় কথা নয় অর্থের যথার্থ ব্যয়ের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত পরিচয় উন্মোচিত হয়। সম্পদ ও অর্থের ব্যয় মানুষ অর্থ উপার্জন করে প্রয়োাজন ও চাহিদা মেটানোর জন্য। কিন্তু চহিদা মেটাতে গিয়ে যদি অর্জিত অর্থের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকে তবে অর্থ-সংকট অবশ্যই দেখা দেবে। বেহিসেবি খরচ করা থেকে সবসময়ই সংযত থাকতে হবে। অর্জিত অর্থ যাতে সঠিক পথে এবং সৎ প্রয়োজনে ব্যয় হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাই অর্থ ব্যয় করার সময় আবেগতাড়িত না হয়ে অর্থ-ব্যয়ের যৌক্তিকতা ও সামর্থ্যকে বিজ্ঞতার সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যিনি অমিতব্যয়ী তিনিই কেবল প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করে থাকেন।
মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে পরিমিত ব্যয়ের দ্বারা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও সুখের অধিকারী হতে পারে। মিতব্যয়ি ব্যক্তিকে কখনোই হতাশা গ্রাস করতে পারে না। মিতব্যয়িতা মানুষকে সংকট মোকাবেলা ও সংকট উত্তরণে সাহসী ও দক্ষ করে তোলে। মিতব্যয়িতা মানুষকে অনেক অবৈধ আকাক্সক্ষা ও অসামাজিক কর্মকর্তা থেকে বিরত রাখে। মানুষ যদি মিতব্যয়ি মাধ্যমে সঞ্চয়ী হয়ে ওঠে তবে যেকোনো কারণে হঠাৎ আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেলেও তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। মিতব্যয়ি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেককে সঞ্চয়ী হওয়া উচিত। সঞ্চয় না থাকলে আপদকালীন দুর্যোগ মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রয়োজন অনুসারে ব্যয় করে উদ্বৃত্ত অর্থ সঞ্চয় করা উচিত। সমাজে দরিদ্র মানুষও যদি মিতব্যয়ি হয় তবে দারিদ্র্যের মধ্যেও সুখ লাভ করা যায়, পক্ষান্তরে, কোনো বিত্তবানও যদি অমিতব্যয়ি হয় তবে তাকে পদে পদে বিপদ গ্রস্ত হতে হয়।
ইসলাম ধর্মে মিতব্যয়িতার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জীবনে এ মন্ত্র গুণটি অর্জনের জন্য কোরান ও হাদিসে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদিসে উল্লেখ আছে যে, ‘অপব্যয়কারী শয়তানের বন্ধু। মিতব্যয়ি ব্যক্তি কৃপণতার নিন্দামুক্ত। কারণ মিতব্যয়ি ব্যক্তির খরচ সবসময়ই আয়ের সঙ্গে সগংতিপূর্ণ হয়। কথায় আছে মিতব্যয়িতা মানব জীবনের একটি উৎকৃষ্ট গুণ। চেষ্টা ও পরিশ্রমের দ্বারা মানুষ যে সম্পদ ও অর্থ অর্জন করে তা একটা পরিকল্পিত হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে ব্যয় করা উচিত। মিতব্যয়িতার সঙ্গে অর্থ ব্যয় করলে অল্প অর্জনেও সুন্দরভাবে জীবন নির্বাহ করা যায়। সুখী সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপনের জন্য সকলকেই মিতব্যয়ী হওয়া উচিৎ। মিতব্যয়িতার মাধ্যমেই তৈরি হয় উন্নতির সিড়ি। ৩১ অক্টোবর বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস। মূলত মিতব্যয়ী হওয়ার আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। এই দিনে পরিবার ও রাষ্ট্রের কল্যাণে সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। দৈনন্দিন জীবনে ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনই মিতব্যয়িতা। অন্যভাবে বলা যায়, কৃপণতা না করে প্রয়োজনমতো অথবা হিসাব করে ব্যয় করার নাম মিতব্যয়িতা।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের জন্য মিতব্যয়িতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কারণ এ দেশের মানুষের মধ্যে অপচয়ের প্রবণতা বেশি। মিতব্যয়িতার সঙ্গে সঞ্চয়ের একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে। কারণ কোনো মানুষ মিতব্যয়ী হলেই সেখান থেকে অর্থ বাঁচিয়ে সেটা সঞ্চয় করতে পারে। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে দেখতাম মা ভাত রান্না করার সময় প্রতিবারই একমুঠো করে চাল অন্য একটি পাতিলে জমিয়ে রাখতেন। এভাবে সপ্তাহখানেক জমানোর পর দেখা যেত সেই জমানো চাল দিয়ে অন্য একদিনের রান্নার চাল হয়ে গেছে। অথবা সেই জমানো চাল বিক্রি করে সংসারের বিভিন্ন ছোট ছোট প্রয়োজন পূরণ হতো। এটাকে বলা হতো লক্ষণীর ভাড়। মানবজীবনে মিতব্যয়িতা একটি অপরিহার্য বিষয়। মিতব্যয় প্রত্যেক মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি বয়ে আনে। ব্যক্তিজীবনে যত বেশি সঞ্চয় হবে, ততই বাড়বে ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা। মিতব্যয় মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করে এবং অন্যকে সাহায্য করার পথ উন্মুক্ত করে। জাতীয় উন্নয়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধি অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সম্পদ সংগ্রহের পন্থা হচ্ছে স্বেচ্ছায় সঞ্চয় এবং কর সংগ্রহের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়। স্বেচ্ছায় সঞ্চয় যত বাড়বে, কর বা রাজস্ব আদায়ের ওপর নির্ভরতা ততো কমবে। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই উন্নত দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। আয় করা যত কঠিন, ব্যয় করা ততোই সহজ। মানুষ আয়েশি জীবনযাপনের জন্য কিছু অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করে, যা তার ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলকর নয়। আমরা আমাদের চারপাশে তাকালে দেখতে পাই- কেউ জীবন দিয়ে পরিশ্রম করেও দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতে পায় না; আবার কেউ মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও ভূমিহীন বা গৃহহীন। তাই বাংলাদেশের মতো একটি দেশের নাগরিকদের জন্য মিতব্যয়িতা অত্যাবশ্যক। অপচয়কারীরা নিজের জন্য তো নয়ই; সমাজ, পরিবার ও জাতির জন্যও কিছু করতে পারে না। সঞ্চয়ের জন্য ধনী হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রত্যেক মানুষের একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন থাকে। এই স্বপ্ন থেকেই জন্ম নেয় প্রত্যয়। দৃঢ় প্রত্যয় থেকেই গড়ে ওঠে সঞ্চয়ের প্রবণতা। মানুষ অর্থ উপার্জনের পর তা খরচ করার তিনটি অবস্থা রয়েছে। এগুলো হল কার্পণ্য, মিতব্যয় ও অপব্যয়। সব ধর্মে মিতব্যয়কে উৎসাহিত করে কার্পণ্য ও অপব্যয়কে নিন্দা জানানো হয়েছে। এ কারণে মিতব্যয় একটি উত্তম কাজ আর কার্পণ্য ও অপব্যয় নিন্দিত কাজ। মিতব্যয় মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করে এবং অন্যকে সাহায্য করার পথ উন্মুক্ত করে। মিতব্যয়ীরা কখনও নিঃস্ব হয় না। প্রতি বছর বিশ্বে কোটি কোটি টন খাদ্য নষ্ট হয়। অথচ বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ১৮ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটায়। সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ অপচয় করে কোটি কোটি টাকার খাবার, আর এর মাশুল দিতে হয় পথের পাশের মানুষগুলোকে। এ সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন মিতব্যয়।
লেখক : কবি।