নতুন মেয়র ও নগরবাসীর প্রত্যাশা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ৪:৪০:০৩ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
হযরত শাহজালাল (রহ.) ১৩০৩ সালে গৌড় গোবিন্দের গৌড় রাজ্য বিজয়ের পর তিনশত ষাট আউলিয়ার পদধূলিতে ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে সিলেট। কবি প্যারীচরণ দাশ লিখেছেন, প্রকৃতির ভা-ারেতে শ্রীহট্টের মাঝে কত শোভা মনোলোভা সর্বত্র বিরাজে। মি. রবার্ট লিন্ডসে সিলেটের কালেক্টর থাকাকালীন সময় তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘সিলেটে আমার বারো বৎসর’ থেকে জানা যায়- সিলেট একটি জঙ্গলে ঢাকা বড় আকারের বাজার ছিল। কালের পরিক্রমায় সভ্যতার ক্রমবিকাশে সিলেট এখন সিটি কর্পোরেশন।
মহানগরের ইতিকথা- পৌরসভা গঠিত হয় শহর অঞ্চলের জন্য। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রথমে অপঃ ‘ঢ’ পাশ হয় ১৯৪২ সালে। পৌরসভা গঠনের জন্যে অপঃ ‘ঢঢঠও’ পাশ হয় ১৮৫০ সালে। সূত্র- (বাংলা পিডিয়া) এবং সরকার মিউনিসিপ্যালিটি ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট পাশ করেন ১৮৬৪ সালে। অত:পর ১৮৬৪ সালে অপঃ ওওও নামে পরিচিত হয় মিউনিসিপ্যালিটি ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট। লর্ড রিপনের আমলে ১৮৮৪ সালে বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট পাশ হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পূর্ববঙ্গে পৌরসভা ছিল ৪৫টি। তন্মধ্যে সিলেটে ছিল ৪টি পৌরসভা এবং ০১টি পৌর কমিটি।
ব্রিটিশ ভারতে সিলেট পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন রায় বাহাদুর দুলাল চন্দ্র দেব। তিনি ১৮৮৩ সাল থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে এবং পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে ১৯৪৬-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন বনবীর লাল, ১৯৫৩ সালে সরকার প্রশাসক নির্বাচিত করেন। ১৯৫৪-৫৭ সাল পর্যন্ত দেওয়ান আব্দুর রব চৌধুরী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং মধ্যখানে সরকার পুনঃরায় প্রশাসক নিয়োগ দেন। ১৯৬১-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী এবং মোঃ ইউসুফ তারু মিয়া ১৯৬৫-৬৯ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভোটে ১৯৭৩ সালে একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবরুল হোসেন বাবুল প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে নানা প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা পেরিয়ে বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হিসাবে আওয়ামী লীগের বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ওয়ার্ড কমিশনার থেকে ১৯৯৫ সালের নির্বাচনে পৌরসভার সর্বশেষ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে মহান জাতীয় সংসদে ৪ এপ্রিল ২০০১ সালে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের রূপান্তর বিল পাশ হলে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০ মার্চ ২০০৩ সালে এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ৪ আগস্ট ২০০৮ সাল থেকে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান দুই মেয়াদে নির্বাচিত মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তীকালে ২০১৩ এবং ২০১৮ সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দল ও জোটের সমর্থন পেয়ে বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী হ্যাট্রিক চান্সে থাকা ১৪ দলের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান এর নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজয় লাভ করেন। পর পর দুই বার দীর্ঘ দশ বছর মহানগরের অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন করেছেন। অতি সম্প্রতি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে এক বিদায়ী গণসম্বর্ধনায় ড. এ কে আব্দুল মোমেন সিলেট-১ এর সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী গর্ব করে বলেছেন, আরিফুল হক চৌধুরী সাহসী কর্মী হিসাবে সার্টিফিকেট দিয়াছেন। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ২০২৩ এর গ্রীণ ক্লিন স্মার্ট সিলেট স্বপ্ন পূরণে ‘আমরার সিলেট’ শিরোনামে ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে ২১ জুন/২০২৩ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী মোঃ আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুলকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মহানগরের সোনার চাবি হস্তগত করেন। আগামী ৭ নভেম্বর ২০২৩ অভিষেকের মাধ্যমে মোঃ আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মহানগরের সেবকের জার্নি শুরু হবে। সিলেট মহানগরের বর্তমান আয়তন ৭৯.৫০ তন্মধ্যে ৪২টি ওয়ার্ডে দশ লক্ষ লোকের বসবাস। বিপুল জনঅধ্যুষিত মানুষের আকাঙ্খিত স্মার্ট সিটি গড়ার দায়িত্ব পড়েছে নবাগত মেয়র মহোদয়ের হাতে এখন নগরবাসী সপ্রশংসিত দৃষ্টি মেয়র মহোদয়ের উপর।
এবার মনের কথায় বলতে হয়, বীরত্বের নির্যাস হলো আত্মবিশ্বাস। নবাগত মেয়রকে সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে তার অভিষ্ট লক্ষে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে।
একজন কলামিস্ট হিসাবে গ্রীণ ক্লিন স্মার্ট সিলেট স্বপ্ন পূরণে নি¤েœাক্ত কতিপয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মেয়র মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
স্যার ফিলিপ সিডনি বলেছেন- আগে সমস্যার কারণ অনুসন্ধান করো, তারপর প্রতিকারের ব্যবস্থা করো।
ড্রেনেজ ব্যবস্থা: সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) মহানগরের সড়কপথকে প্রশস্থ করার লক্ষে সম্প্রতি রাস্তার উভয় পার্শ্বে ড্রেন নির্মাণ করে স্ল্যাব বসিয়ে দিয়েছেন। সড়ক পৃষ্ঠস্থ পানি অপসারণ এবং সড়ক পৃষ্টের সন্নিকটের পানি অপসারণের প্রক্রিয়াকে উৎধরহধমব বলে। সড়ক ধ্বংসের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো বৃষ্টির পানি। সাধারণত: পানি সড়কের সবচেয়ে (ঝঁনমৎধফব) কে নরম ও দুর্বল করে ভার বহন ক্ষমতা কমিয়ে সড়কের স্থায়িত্ব কার্যকারিতা হ্রাস করে। সেহেতু সড়কের পানি নিষ্কাশনের আবশ্যকতা অপরিসীম। সড়কের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থার বিবেচ্য বিষয় হলো (ক) বৃষ্টিপাতের তীব্রতা (খ) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং (গ) রান অফ (জঁহ ড়ভভ)। গবেষণা থেকে জানা যায় জঁহ ড়ভভ মাটিতে পানির প্রবাহকে বুঝায়। এটা প্রকাশ করা হয় লিটার পার সেকেন্ড বা (মিটার) তিন সেকেন্ড। এতে করে বৃষ্টিপাতের ফলে মাটির উপর যে পরিমাণ পানি গড়িয়ে পড়ে তা সহজেই উন্মোক্ত ড্রেনে গিয়ে নিষ্কাশন সম্ভব হয়।
কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে ফুটপাতের পার্শ্বস্থ ড্রেনের ছিদ্রগুলো রাস্তার আবর্জনায় প্রায়শই বন্ধ হয়ে পড়ে। তখন বৃষ্টির পানি অনেক ক্ষেত্রে গড়িয়ে ড্রেনে গিয়ে পড়ে না। অধিকিন্তু বক্স কালভার্ট ও স্ল্যাবের নীচে ড্রেনগুলোতে ইট, পাথর, খোয়া ও তরল আবর্জনা শক্ত হয়ে তলানীতে ঝবফরসবহঃ জমে স্তর হয়ে পড়ে। যারপর ড্রেন দিয়ে পানি প্রবাহিত না হওয়ায় রাস্তার উপর বৃষ্টির পানি চলে আসে এবং রাস্তায় পানি জমে থাকার দরুণ যানবাহনের চাকার ঘর্ষণে রাস্তার কার্পেটিং ও খোয়া উঠে যায়, এবং রাস্তায় খন্দকের সৃষ্টি হয়। মহানগরের দৃশ্যমান রাস্তা বর্ধিত করণের লক্ষে ড্রেনের পর যে স্ল্যাব যুক্ত হচ্ছে তা ম্যানুয়েলি (গধহঁধষু) পরিষ্কার করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাছাড়া স্ল্যাব পুরোপুরি না উঠালে ড্রেনের তলানী পরিষ্কার করা যায় না। এ কাজে দরকার পড়ে এক্সবেটর ও গ্রেডার বক্স। ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার করা না হলে বক্সকালভার্ট ও স্ল্যাবের তলানীতে পানি প্রবাহের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং নিচু এলাকার রাস্তাসহ পার্শ্ববর্তী বাসাবাড়ি এবং দোকান কোটাসহ সবধরনের ব্যবসা কেন্দ্র পানিতে তলিয়ে যায়। সিলেট মহানগরের যে সকল বক্স কালভার্ট ও ড্রেনের স্ল্যাবযুক্ত আছে সেগুলোর দিকে কৌশলগত ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে একজন নগরবাসী হিসাবে মনে করছি। কেননা কৃত্রিম জলাবদ্ধতার জন্য বক্স কালভার্ট ও স্ল্যাবযুক্ত ড্রেন অন্তরায় নয় কী? নবাগত মেয়র মহোদয়কে এতদবিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কিং : উত্তম সড়ক ব্যবস্থার লক্ষে নিরাপদ সড়ক নগরবাসীর কাম্য। লক্ষ করা যাচ্ছে নগরবাসীর পথযাত্রার সাথে মোটর যান সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে পার্কিং একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। পার্কিং সুবিধা না থাকায় রাস্তায় যানজটের সম্মুখীন হতে হয়। সাধারণত: বাণিজ্যিক এলাকা, জনসমাগমের স্থান ও অফিস/আদালত পাড়ায় পার্কিং সমস্যা প্রকটভাবে দেখা যায়। সাধারণত: উন্নত দেশে মূল সড়ক হতে দূরে মোটর পার্কিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের পার্কিং পদ্ধতিকে (ঙহ ংঃৎববঃ ঢ়ধৎশরহম) বলা হয়ে থাকে। আমাদের মহানগরে মূল সড়ক থেকে নিকটবর্তী স্থানে এ ধরনের পার্কিং-এর ব্যবস্থা নাই। সবটুকু জায়গা নিয়ে বহুতল ভবনে আবৃত রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি স্থাপনায় আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কিং ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
জলাবদ্ধতা ও কৃত্রিম বন্যা : মহানগরের মধ্য দিয়ে যেসব ছড়া/খাল প্রবাহিত রয়েছে সেগুলো পুন:খনন কাজ করতে হবে। যদিও বা ছড়া/খাল প্রশস্থ করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের ব্যবধানে ছড়া/খাল ইট পাথর খোয়া এবং আবর্জনায় ভরাট হয়ে পড়েছে। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে আগে ছড়া/খাল পুনঃখনন করে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া মানবসৃষ্ট কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে তা সনাক্ত করে সুরাহা করা আবশ্যক। এমতাবস্থা বন্যা নিরসনে মাস্টারপ্ল্যান ড্রেনেজ প্রকল্প হাতে নিতে হবে এবং ছড়া/খাল ও নালা পুনঃখনন প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই- যানবাহনের জন্য সড়ক বা রাস্তা, পায়ে চলার জন্য ফুটপাত, পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন- এই তিন মাধ্যমকে যত স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যাবে তত দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া যাবে।
লেখক : কলামিস্ট।