জেল হত্যা দিবস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৪৩:০১ অপরাহ্ন
সফল মানুষেরা কাজ করে যায়। তারা ভুল করে, ভুল শোধরায়-কিন্তু কখনও হাল ছাড়ে না। -কনরাড হিলটন
আজ ঐতিহাসিক তেসরা নভেম্বর জেল হত্যা দিবস। আমাদের জাতীয় জীবনে একটি স্মরণীয় বেদনাবহ দিন। একাধারে দিনটি আমাদের জন্য একটি কলংকিত দিনও। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বের কোথাও এ ধরণের দুঃখজনক, বর্বরতম ঘটনা ঘটেনি, যা ঘটেছে আমাদের দেশে এই দিনে। ১৯৭৫ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে গুলি করে নির্মমভাবে খুন করা হয় আজকের এই দিনে। সেই ঘটনাকে স্মরণীয় করে প্রতি বছর তেসরা নভেম্বরকে জেল হত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
প্রতি বছরই জেল হত্যা দিবসে স্মরণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের সেই চার সংগঠককে, যারা জেলের অভ্যন্তরে ঘাতকের বুলেটে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছেন বিশৃংখলা সৃষ্টিকারিদের সঙ্গে, জাতির পিতার হত্যাকারিদের সঙ্গে কোন অবস্থাতেই আপস নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঘটনাবহুল একটি বছর হচ্ছে ১৯৭৫ সাল। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় সেই বছর ১৫ই আগস্ট। একই ধারাবাহিকতায় তেসরা নভেম্বরের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে সেই হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রকারিরাই। সেই কুচক্রী মহলই জেল হত্যার মতো বর্বর ঘটনার জন্ম দেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের চার সংগঠক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং এম মনসুর আলীকেও মন্ত্রীসভায় যোগদানের আহবান জানায় ক্ষমতাদখলকারি বঙ্গবন্ধুর খুনি খোন্দকার মুশতাক। কিন্তু এতে সাড়া দেননি এই চার দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর। যে কারণে তাদের ওপর নেমে আসে নির্মম পরিণতি। খাচায় বন্দি পাখির মতো তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে বন্দিদের গুলি করে হত্যা করার মতো নির্মমতা আর কী হতে পারে? এদেশে আইন আছে, বিচার বিভাগ আছে; কিন্তু এই সবকিছুকেই বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের ইশারায় কারাগারে আটক বন্দিদের গুলি করে মেরে ফেলার মতো ঘটনার জন্ম হলো এদেশে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, কোন সভ্য দেশেই কিংবা সভ্য সমাজেই এমন বর্বরতম ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা থাকার কথা যেখানে, সেই কেন্দ্রীয় কারাগারেই ঘটেছে এই বর্বরতম ঘটনা। সেখানে তখন নিরাপত্তার নামে যারা দায়িত্বরত ছিলো তারা তৎকালীন সরকারের ক্রীড়নক হিসেবেই কাজ করেছে। ফলে এই তথাকথিত নিরাপত্তা বেষ্টনি মধ্যরাতে দুর্বৃত্তদের জেলের অভ্যন্তরে প্রবেশে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। কারারক্ষিদের চোখের সামনেই তাদের নিরাপত্তায় থাকা চার বন্দিকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারি দুর্বৃত্তরা বুলেটে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত করে। মুমূর্ষ চার নেতা যখন মরণ যন্ত্রণায় ছটফটাচ্ছিলেন, তখনই ঘাতকরা বেয়নেট দিয়ে আঘাতে আঘাতে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায় নির্বিঘেœ।
১৯৭৫ থেকে ২০২২। সুদীর্ঘ ৪৭ বছর এদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও জঘন্যতম একটি ঘটনার দুঃখ-কষ্টকে এ জাতি লালন করে আসছে। তার সঙ্গে মিশে আছে ক্ষোভ ও ঘৃণা। এই ঘৃণা হচ্ছে জেল হত্যার জন্য দায়ি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, ক্ষোভ হচ্ছে যারা সেই খুনিদের বিভিন্ন সময় পুরস্কৃত করেছে, রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাতে চেয়েছে-তাদের বিরুদ্ধে। এখন বাস্তবতা এটাই যে, খুনিদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সেই ক্ষোভ আর ঘৃণা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। জেলহত্যার মামলার রায় হয়েছে অনেক আগেই ‘কিন্তু তা এখনও কার্যকর হয়নি। সাজাপ্রাপ্ত অনেকেই এখনও পলাতক রয়েছে বিভিন্ন দেশে। অচিরেই এদের ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করা হোক। সেই সঙ্গে এই ঘটনার পেছনে যারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদেরও আনতে হবে বিচারের আওতায়।
আজকের এই জেলহত্যা দিবসে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ও তেসরা নভেম্বরের হত্যাকান্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হোক, সেইসঙ্গে তেসরা নভেম্বর সরকারি ছুটি ঘোষণা করাও জরুরি বলে আমরা মনে করি।