আসাদ চৌধুরীর সিলেটপ্রেম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৫৮:১৯ অপরাহ্ন

সেলিম আউয়াল
তাঁর বয়েস যখন দশ-এগারো, তখন থেকে কবি আসাদ চৌধুরীর সিলেট আসা শুরু। সেটা ১৯৫৩ অথবা ৫৪ সালের দিকে। তিনি তখন স্কুলে পড়েন। স্কুলের স্কাউট দলের সদস্য হয়ে এসেছিলেন সিলেটে। ধোপাদিঘির পারে স্কাউট-ক্যাম্প হয়েছিলো, সেই ক্যাম্পে রাত্রিযাপন, সিলেটে তখন ছিলেন তিনদিন।
কবি আসাদ চৌধুরী। সিলেটের জন্যে তার আলাদা এক ভালোবাসা বললেন। সিলেটে আমন্ত্রণ জানালে এবং সুযোগ করতে পারলেই চলে আসতেন বিনা বাক্যব্যয়ে। মনে হতো তিনি যেন সিলেট সফরের আমন্ত্রণের অপেক্ষায়। অথচ তার কাছাকাছিও যাবার যোগ্যতা নেই, এমন অনেককে আমন্ত্রণ করলে নানা প্রশ্নÑকী চড়িয়ে নেবেন, কোথায় রাখবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসাদ চৌধুরী বললেন, সিলেট আমার কাছে খুব প্রিয়। সিলেটের আশপাশ আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। তামাবিল আমার অসম্ভব প্রিয় জায়গা। শাহজালালের মাজার শরিফ, শাহপরান যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে আমি গিয়েছি। সিলেটের অনেকগুলো ব্যাপার ছিল আলাদা, এখানে বেড়াতে সবাই গাড়ি নিয়ে আসতাম। গাড়িতে করে আশেপাশে বন্ধুদের সাথে দেখা করতাম, লেখালেখির সব জায়গায় যেতাম। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে ছিলাম। সুনামগঞ্জেও কয়েকবার এসেছি। হবিগঞ্জ মৌলভীবাজার অনেকবার এসেছি। দিরাই যাওয়ার কথা ছিল দু’বার এবং ভিডিও করার কথা ছিল, ছেলেরা ভিডিও নিয়ে এসেছিলো; কিন্তু অসম্ভব বৃষ্টির কারণে যাওয়া হয়নি। এবারও বৃষ্টি ছিল। দিলওয়ারের বাসায় যাওয়া হলোনা এগুলো আমার কাছে অবিশ্বাস্য।
কবি আসাদ চৌধুরীর সাথে কথা বলছিলাম ১ জুলাই ২০১৪, দুপুর বেলার ওয়াক্তে। কবি সালমা বখত চৌধুরীর বাসায়, তার বাসাটি সিলেট শহর থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে খাদিমে। খাওয়াদাওয়া সেরে তার ড্রয়িং রুমে দই খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে কথা হচ্ছিলো কবির সাথে। জিগ্যেস করেছিলাম, সিলেটে কতোবার এসেছেন। হাসলেন, এই হিসেব দিতে পারবো না। কতোবার যে এসেছি, লেখাজোকা নেই।
বললাম প্রথম যখন এসেছিলেন, সেই সময়ের সিলেট শহরের কথা কি মনে আছে? বললেন, অনেক আগের কথা তো, খুব একটা মনে নেই। তারপরও মনে পড়ে ছোট ছোট বাড়ি, সাজানো গোছানো। বাড়ির সামনে ফুল গাছ। খুব পরিচ্ছন্ন একটা শহর ছিল তখন। আর আজকের শহর বড়োলোকের শহর, যানজটের শহর। বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমে যায়। এ ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশন ও কর্তৃপক্ষ কি লক্ষ্য রাখে না? এটা আমার কাছে অবাক লেগেছে।
আমাদের হাতে সেদিন সময় ছিলো খুবই কম। কম সময়েই অনেক কথা বলছিলেন কবি আসাদ চৌধুরীÑ সিলেট সম্পর্কে বাঙালিদের ধারণা হচ্ছে সিলেটিরা আমাদের পাত্তা দেয় না। এই কথাটি একদিক থেকে হয়তোবা সত্য, কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয় না। আমি যেভাবে আপ্যায়ন পাচ্ছি তাতে মনে হয় কথাটা সবটা সত্য নয়। প্রাচীন গ্রাম বাংলার আত্মীয়তা বা ভদ্রতা এখনও বোধ হয় এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে। এই নগর জীবনেও পাওয়া যাবে আমি নিশ্চিত। কিছুক্ষণ আগে কবি সালমা বখত, বিরইনের চাল দিয়ে নারিকেলের গুড়া দেয়া ঘন দুধ দিয়ে চমৎকার পায়েস খাইয়েছেন। আমার মনে হয় না এই রেসিপিটা অনেকে জানে, তবে লন্ডনের অনেকে জানে। লন্ডনে যেসব সিলেটি আছে, আমরা যারা বাংলাদেশে বাস করিÑতার চেয়ে অনেক বেশি তারা বাংলাদেশে বাস করেÑআমার এটা মনে হয়েছে, আমার ভুলও হতে পারে। সিলেটের এই বৈশিষ্ট অনেক বড়ো ব্যাপার, এখানে এবার আসার কিছু দিন আগে লন্ডন আমি গিয়েছিলাম।
জিগ্যেস করলাম, সিলেট নিয়ে আপনার কি কোন কবিতা আছে? সিলেটকে নিয়ে আমার কোন কবিতা নাই। তবে সিলেটের অনেক বিষয় আমার কবিতাতে চলে আসছেÑ খাসিয়া, বড়লেখা, বরমচাল, হাকালুকি।
জিগ্যেস করেছিলাম আপনি কি সিলেটকে নিয়ে লেখবেন। বললেন, আপাতত আমার লেখার প্লান নেই। তবে গবেষকদেরকে অনুরোধ জানাবো লিখতে। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ বাংলা ভাষার পক্ষে বিশাল আকারের সভা করেছে। এখন যেটা সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা, সেই মাদ্রাসায় বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলনের মিটিং হয়। মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন মতিন উদদীন আহমদ সাহেব। সেই মিটিংয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর বক্তব্যের সময় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো উর্দুর পক্ষের লোকজন। এই কথাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে যেভাবে আসার কথা ছিল ঠিক সেভাবে আসেনি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। ১৯৩৬ সনে জন্ম থেকে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ যে কাজটি করেছে, অসাধারণ। আমি বাংলা একাডেমির যখন উপপরিচালক ছিলাম, সংস্কৃতি বিভাগে আমরা সাহিত্য সপ্তাহ উদ্বোধন করেছিলাম মুহম্মদ নূরুল হককে দিয়ে, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে দিয়ে, তারপর আর সম্ভব হয়নি। এরপর মিনিস্টাররা শুরু করেন। আমার ইচ্ছে ছিল নীরবে নিভৃতে লেখালেখি করেন, যেমন আসদ্দর আলী সাহেব, তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাবো।
সাক্ষাৎকারে একটা কমন প্রশ্ন থাকে, অমুকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন। আমাদের সেদিনের সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছিলো। একটু পর তারা ঢাকার গাড়ি ধরবেন। তাই তাকে চটজলদি সেই কমন প্রশ্ন করেছিলাম, তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন। সেইদিন তার শেষ কথা ছিলোÑতরুণদের প্রচুর প্রচুর পড়তে হবে। শুধু বাংলা পড়লে চলবে না। ইংরেজি পড়তে হবে, অনুবাদ করতে হবে। যে কোন একটা বিদেশী ভাষা শেখাটা ভালো। শুধু বই পড়লে চলবে নাÑআকাশ পড়তে হবে, বৃষ্টি পড়তে হবে, দিন পড়তে হবে, অপমান পড়তে হবে, দারিদ্র পড়তে হবে, পুরুষ পড়তে হবে, নারী পড়তে হবে, ভালোবাসা পড়তে হবে, পড়াশোনার দিগন্তটা হতে হবে অনেক বিস্তৃত; প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ যেন না থাকে।