… এবং সাতই নভেম্বর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ৯:১৪:৩৫ অপরাহ্ন
যারা নতুন কিছু খুঁজে না, একদিন তাদেরও কেউ খুঁজবে না। – জে আর আর টলকিন।
আজ সাতই নভেম্বর।দিনটিকে স্বাধীন বাংশাদেশের ইতিহাসে একটি ‘স্মরণীয়’ দিন হিসিবেই আখ্যায়িত করা যায়। স্মরণীয় এজন্য যে, এই দিনকে একেকজন একেক নামে স্মরণ করে। কেউ বলে বিপ্লব ও সংহতি দিবস। কেউ বলে সিপাহি জনতার অভ্যূত্থান দিবস। আবার কেউ বলে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস। আর এক সময় তো এই দিনটিকে ঘটা করেই উদযাপন করা হতো রীতিমতো ‘বিজয় দিবসে’র মতো। দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবেও ঘোষিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর তেসরা নভেম্বর কারাগারে চার নেতা হত্যা, সাতই নভেম্বর এবং তার আগে ও পরে সংঘটিত ঘটনাবলি পক্ষান্তরে এই জাতির জন্য একটি কলংকজনক অধ্যায়। তাই ঘটনার এতোগুলো বছর পরও পঁচাত্তরের নভেম্বরের ঘটনাগুলো আজও একটি অন্যতম রাজনৈতিক আলোচ্য বিষয়।
পঁচাত্তরের নভেম্বর মাসের ঘটনাবলিকে যে যেভাবেই বিশ্লেষণ করেন না কেন, বাস্তবে যেটা ঘটেছে তা হলো- তখন দেশে ঘটেছে সেনা অভ্যূত্থান-পাল্টা অভ্যূত্থান, মেরে ফেলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও অত্যন্ত মেধাবি সেনা অফিসার খালেদ মেশাররফ, কর্ণেল হুদা, হায়দার, কর্ণেল তাহেরসহ সহ¯্রাধিক সামরিক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনীতিবিদকে। বিশ্লেষকদের মতে, সাতই নভেম্বর মূলত তিনটি পক্ষ তাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে জাতির জন্য এই কলংকজনক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। এই তিন পক্ষ হচ্ছে- সেনা অফিসার খালেদ মোশাররফ, ক্ষুব্ধ সেনা অফিসার জিয়াউর রহমান এবং কর্ণেল তাহের ও জাসদ। ঘটনার পরিক্রমায় পঁচাত্তরের এই দিনে, তেসরা নভেম্বর ক্ষমতা দখলকারি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের কাছ থেকে ক্ষমতা হস্তগত করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। আর সেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে রক্তাক্ত পথে। খালেদ মোশাররফসহ বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার, সেনা সদস্যের রক্তের বিনিময়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। এই ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন কর্ণেল তাহের ও তার অনুসারিরা। আপাতদৃষ্টে তখন জিয়াউর রহমান শুধু সেনাবাহিনী প্রধানের পদটি দখল করেছিলেন বলে মনে হলেও বাস্তবে তিনিই রাষ্ট্রের পূর্ণ ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আর সাতই নভেম্বর তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টিকে ‘সিপাহি জনতার জয়’ বলে প্রচার করেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, তেসরা নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি রেখেই ক্ষমতা দখল করেন খালেদ মোশাররফ। আর জিয়াকে মুক্ত করার ‘দায়িত্ব’টি পালন করেন কর্ণেল তাহের। যদিও পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের তৈরি প্রহসনের বিচারে কর্ণেল তাহেরের ফাঁসি হয়। আসলে নভেম্বরের ওই ঘটনাবলিকে জাসদ ও অঙ্গ সংগঠনের চরম হঠকারি ও উচ্চাভিলাষি তৎপরতা এবং কতিপয় সেনা অফিসারের উচ্চাকাংখা চরিতার্থ করার দেশদ্রোহি চক্রান্ত বলেই গবেষকগণ অভিমত দিয়েছেন। যার চরম খেসারত দিতে হয়েছে সহস্র সেনা অফিসার, সেনা সদস্য ও সাধারণ মানুষকে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, এমনি এক কলংকজনক, বেদনাদায়ক, লজ্জাজনক দিনকে ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’ কিংবা ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করার মতো ঘটনাও ঘটছে এ দেশে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি ও সেনা হত্যার ‘মহোৎসবের’ দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন সত্যি দুঃখজনক। সর্বোপরি, সাতই নভেম্বরের ‘বিজয়ি’রা আামাদের মহান স্বাধীনতার চেতনাবিরোধি একটা ¯্রােত তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই প্রেক্ষাপটে সাতই নভেম্বরকে ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা এবং ওই সময়ের পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশের আহ্বান জানাচ্ছেন গবেষক ও বুদ্ধিজীবীগণ।