দরকার কড়া নজরদারি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ৯:১৭:০৫ অপরাহ্ন
গোলাম সারওয়ার
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পতনের জন্য একদিকে ষড়যন্ত্র চলছিল। অন্যদিকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী বিপুল পরিমাণে ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত ছিল। ঠিক একই কায়দায় বা এর চেয়েও বেপরোয়া গতিতে বাংলাদেশে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা মুনাফা ঘরে তুলে নিচ্ছে। সরকার পতনের আন্দোলন কর্মসূচিতে মুনাফার মাত্রা আরো বেড়েছে। এদের রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কারো নেই। খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী এবং দেশের অর্থ পরিকল্পনামন্ত্রী তা অকপটে স্বীকার করেছেন। ফলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা আরো বহুগুণ বেড়েছে।
সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের নিয়ে এর আগে আমরা আরো কয়েকবার লিখেছি। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী কারা? অবশ্যই ফুটপাতের ব্যবসায়ী নয়। নয় ছোট ছোট দোকানীও। এমনকি পাইকারী বিক্রেতাও সিন্ডিকেট করে না। ডিলার-ডিস্ট্রিবিউটরও সিন্ডিকেট করার সাহস পায় না। তাহলে বুঝা গেল সিন্ডিকেট করতে সাহস লাগে। সাহসের উৎস কোথায়? সাহসের উৎস টাকা। সিন্ডিকেট করতে অনেক টাকা লাগে যা ছোট ছোট ব্যবসায়ী, পাইকারি বিক্রেতা, ডিলার পরিবেশকদের পক্ষে সম্ভব নয়। সিন্ডিকেট করতে কত টাকা লাগে? হাজার হাজার কোটি টাকা। শত কোটি টাকায় সিন্ডিকেট হয় না- যে কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পক্ষে তা সম্ভব হয় না।
সিন্ডিকেট করে কর্পোরেট কোম্পানীগুলো। এদের চিহ্নিত করা খুব সহজ, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। দেশে ৭টি কর্পোরেট কোম্পানী রয়েছে। সাতশ বা সাত হাজার কর্পোরেট কোম্পানী থাকলে সিন্ডিকেটওয়ালাদের নিয়ন্ত্রণ করা দূরে থাক চিহ্নিতই করা যেত না। দেশে মাত্র সাত কর্পোরেট কোম্পানী, এরাই সিন্ডিকেট করে অথচ এদের নিয়ন্ত্রণ করা, আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা খুবই দুরূহ কাজ। কারণ, মন্ত্রী, আমলা, সরকারি দল, বিরোধীদল, নেতা নেত্রী কোনো না কোনো উপায়ে এই ৭ কর্পোরেট কোম্পানীর সাথে জড়িত। ফলে চিহ্নিত করা গেলেও এদের রুখে দাঁড়াবার ক্ষমতা কারো নেই।
এই ৭ কোম্পানী সিন্ডিকেট করার জন্য এত টাকা পায় কোথায়? যেহেতু সরকারি দল, বেসরকারি দলের ক্ষমতাধরেরা এদের সাথে জড়িত, ব্যাংক লোন পাওয়া খুবই সহজ। ব্যাংকের টাকায়ই সিন্ডিকেট চলে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো এদের ‘সিন্ডিকেট লোন’ দেওয়ার জন্য অনেক বেশি আগ্রহী। কারণ, এদের লোন দিলে তাড়াতাড়ি রিকভার হয়। এতে ব্যাংকের প্রচুর মুনাফা হয়, অপরপক্ষে ব্যাংকগুলো পার্সোনাল লোন, হোম লোন বা কৃষি লোন দিতে একেবারেই আগ্রহী হয় না।
ব্যাংকের সহায়তায় সিন্ডিকেট ব্যবসা এখন রমরমা। এই রমরমা অবস্থা থামবে বলে মনে হয় না। ব্যাংকের টাকায় হিমাগারের পর হিমাগার কিনে নেয় সিন্ডিকেটওয়ালারা। ফলে আলুর দাম কমে না। সরকারের আদেশও কার্যকর হয় না। তেমনিভাবে ডিম কিনে নেয়া হয় দেশে যত খামার আছে সেখান থেকে। ডিম তাহলে কার কথা শুনবে? মুরগীর কথা শুনবে না সিন্ডিকেটের কথা শুনবে? একই কথা পেঁয়াজের বেলায়ও। ব্যাংকের টাকায় সিন্ডিকেটওয়ালারাই পেঁয়াজ আমদানি করে। অতএব, দাম কেন কমবে?
সেই বাঘ ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ কামড়ায় না যতক্ষণ না সে মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে। বাংলাদেশের সিন্ডিকেটওয়ালারা সিন্ডিকেট করা শিখে ফেলেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এরা সিন্ডিকেট ছেড়ে দেবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। ব্যাংক যতক্ষণ না সিন্ডিকেট লোন দেয়া বন্ধ করবে ততক্ষণ এরা সিন্ডিকেট করেই যাবে। কিন্তু ব্যাংকের এই অপতৎপরতা বন্ধ করবে কে? ব্যাংক যেখানে ইন্টারেস্ট বেশি পাবে সেখানে তো এরা লোন দেবেই। তাছাড়া ‘সিন্ডিকেট লোন’ ইস্যুতে ঝুঁকিও কম। খুব কম সময়ের জন্য এরা লোক নেয়, এবং যথাসময়েই লোন রিকভারি হয়। সিন্ডিকেটিদের ফাইল-পত্রও আপ-টু-ডেট থাকে। নথিপত্র সবসময়ই ফাইলে আপ-টু-ডেট থাকায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই হাজার কোটি টাকা লোন পেয়ে যায়। ফলে আড়তের পর আড়ত, হিমাগারের পর হিমাগার এদের সিন্ডিকেশনে চলে যায়। পণ্যের মূল্য এদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইচ্ছে করলে কমাতে পারে। কিন্তু কখনোই কমানোর ইচ্ছে করে না। যে কারণে দিন দিন প্রতিটা পণ্যের মূল্য বাড়ে ছাড়া কমে না। আলু, পেঁয়াজ, ডিম শুধু নয়- সব পণ্যেই এরা নিয়ন্ত্রক।
জিনিসপত্রের দাম কমলেও যে প্রফিট হতে পারে সেটা সিন্ডিকেটওয়ালারা বিশ্বাস করে না। দাম বাড়ালেই প্রফিট হয়- এই নীতিতেই এরা বিশ্বাসী। দাম কমলেও যে প্রফিট হয় একবার দেশের শেয়ার বাজার ঘুরে আসলেই বুঝা যাবে। শেয়ার বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়লেও লাভ হয়, দাম কমলেও লাভ হয়। এই নীতিটুকু অর্থনীতিবিদরা কিভাবে বিশ্লেষণ করেন, তা অবশ্য আমার জানা নেই। তবে দেশের শেয়ার বাজারে এবং আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারেও আমি তা দেখেছি, উপলব্ধিও করেছি।
সিন্ডিকেটওয়ালা কখন তৎপর হয়? বৈশ্বিক মন্দায়, বৈশ্বিক মহামারিতে, উৎসবে বা রাজনৈতিক অস্থিরতায়। করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে এরা প্রচুর মুনাফা করেছে। করোনার সময় এরা সব ধরনের পণ্যে দাম বাড়িয়েছে। বিশেষ করে হাত ধোয়ার সামগ্রীতে বা স্যানিটাইজেশনের পণ্যগুলোতে দাম বাড়িয়ে মুনাফা করেছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের দোহাই তুলে আমাদের কৃষিজাত পণ্যেও ফায়দা লুটেছে।
রমজান এলেই জিনিসপত্রের দাম নীল আকাশ ছুয়েও ঠান্ডা হয় না। শুধু চাই আর চাই। আমাদেরও দোষ আছে। উৎসবে বা কোনো পার্বণে মাত্রাতিরিক্ত পণ্য ক্রয়ের আসক্তি। এই আসক্তি কিন্তু পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আরো একটি কারণ। আমাদের দুঃখ দুর্দশা দূর করতে হলে অযথাই পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকতে হবে। বাজারে চাপ থাকলে পণ্যের মূল্য উর্ধ্বগতি সিন্ডিকেশন ছাড়াই হতে পারে। যার যতটুকু পণ্যের দরকার ততটুকুতে থাকতে পারলে পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক থাকতে পারে।
ইলিশ এত যে দাম উঠে গেল, কোনো বিক্রেতা কি হতাশ হয়ে বসে থাকল? প্রচুর ইলিশ উৎপাদন হলেও দাম কমেনি ইলিশের। দামি পণ্য না কিনলেই হতো। সিন্ডিকেটের কারণে হঠাৎ করে মরিচের দাম বেড়ে যায়। যখন দাম বাড়ে অল্প কিনে বাড়ি ফিরলেই হতো। কিন্তু এমনটা না করে দাম বাড়ার সময় আমরা আরো বেশি কিনি। ফলে বাজার উর্ধ্বমুখীই থাকে। অথচ পচনশীল দ্রব্য ৫ দিন ক্রয় থেকে বিরত থাকলেই দাম কমে আসত, যত বড় সিন্ডিকেটই থাকুক। দিন আনে দিন খায় লোকদের কথা ভেবেও পণ্য কেনার অসম প্রতিযোগিতা বা আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের।
দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন যতই হোক গরীব লোকের সংখ্যা কিন্তু এখনও অনেক বেশি। গরীব লোকগুলোর প্রতি চিন্তা করে সিন্ডিকেট বিজনেস বন্ধ হওয়া উচিত। সরকার পতনের জন্য এই যে এখন হরতাল অবরোধ চলছে এর মধ্যে আবার পণ্যের দাম বাড়বে। অবরোধে দিন আনে দিন খায় লোকদের অবস্থা খুবই চরমে। অবরোধে এদের দিনে আনে দিনে খাবার ব্যবস্থাও অচল। এমতাবস্থায় সিন্ডিকেশন বিজনেস যাতে সচল না থাকতে পারে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। মন্ত্রী-আমলারা ফেইল হলেও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেইল হবে এমনটা আমাদের আশায় নেই। জনগণ তথা সাধারণ মানুষের যাতে অকল্যাণ হয় এমন অপতৎপরতা ব্যাংকগুলোর থেকে থাকলে, আমরা অনুরোধ করি বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসুক কড়া নজরদারি প্রয়োগে।