বিজ্ঞান সর্বত্র
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ নভেম্বর ২০২৩, ৪:২৫:৩২ অপরাহ্ন
বিজ্ঞান হচ্ছে নির্ভুল জ্ঞান। তা পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যুক্তিপ্রণালী মারফৎ অর্জিত রীতিবদ্ধ জ্ঞান। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বার বার পরীক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব।
অধ্যয়ন ও গবেষণার সুবিধার্থে জ্ঞান জগতকে বিভিন্ন বিষয়ে ভাগ করা হয়েছে, যেমন- জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, সাহিত্য, সঙ্গীত বিদ্যা, দর্শন ইত্যাদি। এগুলোকে আবার বিভিন্ন অনুষদের অধীন রাখা হয়েছে, যেমন- বিজ্ঞান অনুষদ, কলা অনুষদ, আইন অনুষদ, প্রকৌশল অনুষদ ইত্যাদি।
অনেকে মনে করেন ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য ইত্যাদিতে বিজ্ঞান নেই। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। এখন আমরা দেখব বিজ্ঞানের উপস্থিতি সর্বত্র-
ইতিহাস- ইহা কলা অনুষদের অন্তর্গত একটি বিষয়। ইতিহাসের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে ভূগোল, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি, এবং উপরোক্ত বিষয়গুলো বিজ্ঞানের অন্তর্গত। ইতিহাসে বর্ণিত রাজা-বাদশার রাজত্বকাল ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার নির্ভূল সময় নির্দেশ করে থাকে পঞ্জিকা, যা বিজ্ঞানের বিষয়। ইতিহাসের একটি শাখা হচ্ছে প্রতœতত্ত্ববিদ্যা, যা ভূগর্ভে বিলীন প্রাচীন নগর, ঘরবাড়ি, রাস্তা, যুদ্ধাস্ত্র, অলংকার, মুদ্রা, মূর্তি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান চর্চা করে। মাটি খনন করে বিলুপ্ত দ্রব্য সমুদয় অক্ষতভাবে উদ্ধার এবং এগুলোর প্রাচীনত্ব নির্ধারণ ও সঠিক বর্ণনা প্রদান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্য ব্যতীত অসম্ভব। অতএব ইতিহাসে বিজ্ঞানের উপস্থিতি অনস্বীকার্য।
ভাষা ও সাহিত্য- প্রায় সবাই মনে করেন ভাষা ও সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। তা ঠিক নয়। ভাষার ভিত্তি হচ্ছে ব্যাকরণ। ব্যাকরণ ভাষার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বাক্য, শব্দ ও ধ্বনির বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণ করে ভাষার নীতিমালা উপস্থাপন করে থাকে। অধিকন্তু ব্যাকরণের অন্যতম বিষয় স্বরবিজ্ঞান বা শব্দবিজ্ঞান (চযড়হবঃরপং)। স্বরবিজ্ঞান উচ্চারিত কথার বিজ্ঞান ভিত্তিক নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে। অতএব ভাষার ভিত্তি নির্মাণে বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
সাহিত্য হচ্ছে শিল্পগুণে রঞ্জিত লিখিত বস্তু। মানুষ, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির চমৎকার বিবরণ সাহিত্যে বিরাজমান। তাছাড়া ভূপ্রকৃতি, পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, জীবজন্তু ও তরুলতার বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয় তথ্যে সাহিত্য থাকে সমৃদ্ধ। অধিকন্তু ঋতু বৈচিত্র্যের চমকপ্রদ বর্ণনাও সাহিত্যে পাওয়া যায়।
সত্য ও সৌন্দর্যের জন্য ত্রুটিমুক্ত ও নির্ভুল অর্থাৎ বিজ্ঞান সম্মত তথা সাহিত্যের জন্য অপরিহার্য এবং নির্ভুল ও বিশুদ্ধ তথ্য কেবল বিজ্ঞান সরবরাহ করতে পারে। অতএব সাহিত্যে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য।
ললিতকলা- চিত্রকলা, ভাস্করবিদ্যা, সঙ্গীত, নাট্যকলা ইত্যাদি নিয়ে ললিত কলা। ললিতকলার প্রতিটি শাখা বিজ্ঞান দ্বারা পুষ্ট।
একজন চিত্রশিল্পী তার চিত্র কর্মকে কেবল দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলেন না। তিনি তার চিত্রকে সবরকমের ত্রুটিমুক্ত রাখতে চিত্র বিষয়ক নির্ভুল তথ্য অর্থাৎ বিজ্ঞান সম্মত তথ্য, জ্যামিতি, পরিপ্রেক্ষণ, ব্যবহৃত রং-এর উৎকৃষ্ট ভৌতিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য মান অনুসরণ করে থাকেন। এসবই বিজ্ঞানের বিষয়। উপরন্তু চিত্র কর্মে ব্যবহৃত পেন্সিল, কলম, রং, তুলি, ক্যানভাস, ইজল ইত্যাদি বিজ্ঞানেরই উপহার।
ভাস্কর্য হচ্ছে, কাদামাটি, কাঠ, পাথর বা ধাতু দিয়ে তৈরি প্রাণীর মূর্তি বা বিমূর্ত অবয়ব। একজন ভাস্কর বিজ্ঞানের নীতিমালা অনুসরণ করে ভাস্কর্য নির্মাণ করে থাকেন। তার ব্যবহৃত হাতিয়ার বিজ্ঞানের উপহার।
সঙ্গীত হচ্ছে ললিত কলার জনপ্রিয় শাখা। নি¤œলিখিত বিষয় সমূহ সঙ্গীতের অপরিহার্য উপাদান- টিম্বার (ঃরসনৎব) বুনন (ঞবীঃঁৎব), ছন্দ, স্বর-মাধুর্য্য বা লয়, তাল (ইবধঃ), সমতাল বা স্বর-সামঞ্জস্য (ঐধৎসড়হু), টেম্পো (ঞবসঢ়ড়), পিচ (চরঃপয) ও ডাইন্যামিক্স (উুহধসরপং)। উপাদানগুলো বিজ্ঞান সঞ্জাত।
অভিনয় ও নাট্যকলায়ও বিজ্ঞান রয়েছে। নাট্যাভিনয়নের ডায়্যালগে বিজ্ঞান বিদ্যমান। তাছাড়া নাটক মঞ্চায়নে বিভিন্ন রকমের আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, লাউড-স্পিকার, বৈচিত্র্যপূর্ণ আলোর ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক, এবং এসবই বিজ্ঞানের অবদান।
অতএব দেখা যাচ্ছে, ললিতকলার সকল শাখায় বিজ্ঞান আপন মহিমায় বিদ্যমান।
ধর্মে বিজ্ঞান- অধিকাংশ মানুষ মনে করেন ধর্মে বিজ্ঞান নেই। আসলে ধর্মেও বিজ্ঞান উপস্থিত। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্নে সর্বশক্তিমান আল্লাহ প্রথম মানব আ. কে প্রকৃতিতে বিরাজমান বস্তু সমূহ সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দান করেছিলেন। রসুলবৃন্দ (অবতারগণ) ঐশ্বরিকভাবে জগৎ সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান লাভ করতেন। তাঁদের জ্ঞান কেবল ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। পারিবারিক, সামাজিক, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়েও তাঁদের সময়োপযোগী নির্ভুল জ্ঞান ছিল। প্রত্যেক রসুল (অবতার) ছিলেন তাঁর সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি। তাঁরা তাঁদের অনুসারীদের জগৎ সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দান করতেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন। তাঁরা মানবজাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে আসেন নাই। তাই বিভিন্ন ঐশী প্রত্যাদেশগুলোর মধ্যে নি¤েœাক্ত মৌলিক বিষয়ে অভিন্ন বাণী পাওয়া যায়।
সর্বশক্তিমান ¯্রষ্টা এক ও অদ্বিতীয়- পবিত্র কুরআন ৩:২, ২১:২৫ ১১২:১, ৩। পবিত্র বাইবেল, দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৪, মার্ক ১২:২৯, ৩২; যিশাইয়: ৪৩:১০, ১১; ৪৫:৫, ৬; ৪৬:৯। পবিত্র তাওরাত, দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৪। সনাতন ধর্মগ্রন্থ, চান্দগোয়া উপনিষদ ৬:২:১; যুজুর্বেদ ৩২:৩; ৪০:৮; ঋগবেদ ৮:১:১, ৬:৪৫:১৬; সুভাস ভাট্টারা উপনিষদ ৪:১৯, ২০; ৬:৯
বহুত্ববাদ নিষিদ্ধ- পবিত্র কুরআন ৪:৪৮, ১১৬, ৫:৭৬; ৬:১৫১; ১০:৬৬; ৪১:৩৭; ৭৪:৫। পবিত্র বাইবেল ও তাওরাত যাত্রাপুস্তুক ২০:২-৫; দ্বিতীয় বিবরণ ৫:৭-৯। সনাতন ধর্মগ্রন্থ, ভগ¦দগীতা ৭:২০; যুজুর্বেদ ৪০:৯; সুভাস ভাট্টারা উপনিষদ ৬:৯।
শেষ বিচার দিন- পবিত্র কুরআন ১৯:৯৩, ৬৯:১৩, ১৫, ১৬; ৮২:১-৪; ৯৯:৬-৮। পবিত্র বাইবেল, যোহন ৫:২৮:২৯। যোয়েল ২:১; যিশাইয় ৩৪:৪
স্বর্গ- পবিত্র কুরআন ৩:১৫; ৫৪:৫৪, ৫৫। পবিত্র বাইবেল, লুক ২৩:৯৪; প্রত্যাদেশ ২:৭। অথর্ববেদ ৪:৩৪:২, ৬ (দেবীচাঁদ)।
নরক- পবিত্র কুরআন ৭৮:২১-২৩; ৯২:১৪-১৬। পবিত্র বাইবেল, মথি ৫:২২; ১০:২৮। ঋগবেদ ৪:৫:৪।
সুদ নিষিদ্ধ- পবিত্র কুরআন ২:২৭৫, ২৭৮, ২৭৯, ৩:১৩০। পবিত্র বাইবেল, লেভিটিকাস ২৫:৩৬, ৩৭; দ্বিতীয় বিবরণ ২৩:১৯; লুক ৬:৩৫। পবিত্র তাওরাত, লেভিটিকাস ২৫:৩৬:৩৭; দ্বিতীয় বিবরণ ২৩:২০। মনুসংহিতা ৮:১০২।
শূকর ভক্ষণ নিষিদ্ধ- পবিত্র কুরআন ৫:৩; ১৬:১১৫। পবিত্র বাইবেল ও তাওরাত, লেভিটিকাস ১১:৭, ৮; দ্বিতীয় বিবরণ ১৪:৮।
মদপান নিষিদ্ধ- পবিত্র কুরআন ২:২১৯; ৫:৯০, ৯১। পবিত্র বাইবেল, প্রবাদবাক্য ২০:১; ইফিসিয় ৫:১৮।
বিবাহ বহির্ভূত যৌন মিলন নিষিদ্ধ- পবিত্র কুরআন ১৭:৩২; ২৪:২। পবিত্র বাইবেল, যাত্রাপুস্তক ২০:১৪; দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১৮; মথি ৫:২৭, ২৮; লেভিটিকাস ২০:১০। পবিত্র তাওরাত, যাত্রাপুস্তক ২০:১৩; দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১৭; লেভিটিকাস ২০:১০
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে মৌলিক বিষয়ে সাদৃশ্য স্বাভাবিক। কারণ প্রত্যাদেশগুলো একই সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে রসুলগণের নিকট অবতীর্ণ, এবং তা নির্ভুল সত্য ও বিজ্ঞান সম্মত; মানব জাতির জন্য কল্যাণকর। দুর্ভাগ্য, অধিকাংশ মানুষ নিজ ধর্মগ্রন্থের নির্ভুল বাণী উপেক্ষা করে নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করেছেন, যা কল্পনা প্রসূত, ভিত্তিহীন ও অবৈজ্ঞানিক। ফলে জগতে অসংখ্য ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে।
দৈনিক, সাপ্তাহিক ও বার্ষিক ধর্মীয় প্রার্থনা ও উৎসবের সময় নির্ণয়ে সৌর ও চান্দ্র পঞ্জিকার ব্যবহার আবশ্যক। পঞ্জিকা বিজ্ঞানের উপহার। অতএব ধর্মেও বিজ্ঞান অপরিহার্য।
দর্শনে বিজ্ঞান- দর্শন শাস্ত্র কলা অনুষদের অন্তর্গত হলেও এর ভিত্তি হচ্ছে বিজ্ঞান। উইকিপেডিয়ায় উল্লেখ আছে, ‘দর্শন শাস্ত্রকে বিজ্ঞানের বিজ্ঞান বলা যায়, এই অর্থে যে, প্রকৃত পক্ষে এটি সকল বিজ্ঞানের জন্য আত্মোপলব্ধি এবং এমন একটি উৎস, যা থেকে বিজ্ঞানের সব শাখা মহাবিশ্ব সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণার পদ্ধতিগত নিয়ম তৈরি করে। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত রূপ লাভ করেছে।’
পরিশেষে বলতে হয়, জ্ঞানের সকল শাখায় ও প্রকৃতির সর্বত্র বিজ্ঞান আবশ্যিকভাবে বিরাজমান। যেখানে সত্য, সেখানে বিজ্ঞান রয়েছে, এবং যেখানে বিজ্ঞান আছে সেখানে সবই সত্য।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, এম.সি কলেজ, সিলেট