টেকসই উন্নয়ন ও ইমাম সমাজ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ নভেম্বর ২০২৩, ৪:২৯:১৪ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ এহসান উদ্দিন
জাতিসংঘের উদ্যোগে সকল মানুষের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে একটি অধিকতর টেকসই সুন্দর বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সর্বজনীনভাবে একগুচ্ছ সমন্বিত কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এতে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এম.ডি.জি)’র মেয়াদ শেষে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গৃহীত হয়। প্রতিটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এটি সফলভাবে বাস্তবায়নের মধ্যে। এস ডি জির সফলতার মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতসমূহ মোকাবিলা করে একটি টেকসই ও নিরাপদ বিশ্ব আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সামাজিক উন্নয়নের উপর নির্ভর করে একটি রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন। সামাজিক উন্নয়নের সাথে সাংস্কৃতিক প্রযুক্তিগত, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি উপাদানসমূহের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিভিন্ন রকমের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করলেও নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবে সমাজের সার্বিক উন্নয়নে তা ফলপ্রসূ হয়না। তার প্রধান কারণ, উন্নয়নের সাথে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ কাঙ্খিত ব্যক্তি হতে পারেন একজন মসজিদের ইমাম বা ইমাম সমাজ।
বাংলাদেশের ছিয়াশি হাজার গ্রামে প্রায় চার লক্ষ মসজিদ রয়েছে। এ মসজিদগুলোতে প্রায় আট লক্ষাধিক ইমাম, খতীব, মুয়াজ্জিন ও খাদিম নিয়োজিত রয়েছেন। যারা ইচ্ছে করলেও কোনো অনৈতিক কাজে জড়িত হতে পারেননা। দুর্নীতি করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে মসজিদের ইমামের পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে ইমামতি ছাড়াও একজন ইমাম এসডিজি’র ১৭ টি অভীষ্টের ১/ দারিদ্র্য বিলোপ, ২/ ক্ষুধা মুক্তি, ৩/ সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ, ৪/ মানসম্মত শিক্ষা ৫/- নারী পুরুষের সমতা, ৬/ নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, ৭/ সাশ্রয়ী ও দুষণমুক্ত জ্বালানি, ৮/ যথোচিত কর্ম ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ৯/ শিল্প উদ্ভাবন ও অবকাঠামো, ১০/ অসমতা হ্রাস, ১১/ টেকসই নগর ও সমাজ, ১২/ দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন, ১৩/ জলবায়ু কার্যক্রম, ১৪/ জলজ জীবন, ১৫/ স্থলজ জীবন, ১৬/ শান্তি ও ন্যায়বিচার কার্যক্রম প্রতিষ্ঠান, ১৭/ লক্ষ্য পূরণে অংশীদারিত্ব ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে সক্ষম। এম ডিজির লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। এমডিজিতে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে। ইউনিসেফ এর তথ্য মতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের সিংহভাগই অর্জিত হয়েছে ইউনিসেফের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে। আর এর মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন মসজিদের ইমাম খতীব ও মুয়াজ্জিনগণ। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির তান্ডবে কর্মচঞ্চল ধরিত্রী যখন মুখ তুবড়ে পড়েছিল। সবদিকে লকডাউন আর লকডাউন। বাংলাদেশ সরকারের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিতে টঘওঈঊঋ এর দেয়া জরিফ তথ্য মতে ৮৪% সফলতা অর্জিত হয়েছে মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে। ঊচও কর্মসূচীর ৬৫% সফলতা লাভ হয়েছে মস্ক মাইকিং এর ফলে। শিক্ষায়, প্রাক প্রাথমিকে ভর্তির ক্ষেত্রে মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কর্মসূচিতে কোর্স সমাপনকারী ৮০% শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। প্রতিটি জুমায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালকগণ মসজিদের ইমাম খতীবদের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মন্ত্রী পরিষদ বিভাগসহ ৪৯টি মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের বিভিন্ন নির্দেশনা পড়ে সমবেত মুসল্লীদের জানান দেয়া হয়।কোন প্রকার অর্থ ব্যয়ছাড়া, বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন, সেমিনার, এডভোকেসি প্রোগ্রাম, লিফলেট, প্রচারপত্র ছাড়াই সচেতনতা, প্রচারণা, গুড়ামী দূর করা, গুজব দূর করা, আচরণ পরিবর্তন, অজ্ঞতা কুসংস্কার দূরীকরণ, উদ্যোক্তা তৈরী করা সহ হাজারো বিষয়ে মসজিদের ইমাম খতীবগণ বিপ্লবাত্মক ভুমিকা রেখে যাচ্ছেন।
মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট জনবল তথা ইমাম, খতীব, মুয়াজ্জিন ও খাদিম এমন একটি সম্ভাবনাময় ও শক্তিশালী জনসম্পদ যারা দেশ- জাতি, সমাজ ও পরিবেশের উন্নয়নে প্রচারবিমুখ নিরন্তর কর্মরত রয়েছেন। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাসবাদ দমন, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কার্যক্রম, মাদক নির্মূল, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি, সহাবস্থান, পরমত সহিষ্ণুতা, উগ্রবাদ দমন, গুজব বন্ধে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা বিস্তার, খুন ধর্ষণ, চুরি ডাকাতি, মানব পাচার প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টিতে, সুদ, ঘুষের বিরুদ্ধে জনমত তৈরী সহ বাংলাদেশের ৪৯ টি মন্ত্রণালয়ের / বিভাগের, দপ্তর, অধিদপ্তরের সকল উন্নয়ন ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমে দৃষ্টিকাড়া ভুমিকা পালন করতে সক্ষম। আধুনিক বিশ্বে সকল দেশরই লক্ষ্য হচ্ছে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যার মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। উন্নয়নের সাথে সাথে সুবিচার- সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সকল দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা লাঘব করা। দুর্নীতি দমন করা। উন্নয়শীল দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে যে গুলোকে প্রধান বাধারূপে আখ্যায়িত করা হয় তন্মধ্যে দুর্নীতি ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ ই হচ্ছে প্রথম। আমাদের প্রাণের দেশ বাংলাদেশে দুর্নীতি একটা জগদ্দল পাথরের মতো রাষ্ট্রের ওপর চেপে বসেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সদ্য স্বাধীন দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা দৃষ্টে দু’টি কালজয়ী উক্তি করেছিলেন (ক) ‘লোকে পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি’। তাঁর অন্য উক্তিটি ছিল ‘আমি ভিক্ষা করে সম্পদ আনি, চাটার দল সেগুলো খেয়ে যায়’। সেহেতু বলা হয় দুর্নীতি একটি জাতির জন্য অভিশাপ স্বরূপ। এই অভিশাপ একটি রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। দুর্নীতি একটি জাতিকে সৃজনশীলতা থেকে বিমুখ করে ফেলে। দেশপ্রেমহীন মেধাবিমুখ জনসমষ্টিতে পরিণত করতে পারে রাষ্ট্রকে। তরুণ সমাজের বুকে লালিত স্বপ্নকে ভেঙ্গে খান খান করে দিতে পারে। এজন্যই সভ্য সমাজের সব মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দুর্নীতি দূর করার জন্য প্রত্যেকের চেষ্টার কমতি নেই। গঠন করা হল দুর্নীতি দমন কমিশন। এতেও সরিষায় ভুত লুকিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ নামক অমিত সম্ভাবনার এ স্বর্ণপূরীতে রাষ্ট্রের সকল ক-পয়েন্টে তথা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া দূর্নীতি কমিয়ে এনে ২০৩০ সালের মধ্যে (এসডিজি) অর্জন করে ভারসাম্য পূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দের নিকট, রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের এবং মসজিদ পরিচালনা কমিটির দায়িত্বশীলদের প্রতি নিম্নোক্ত বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি মনে করছি।
১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রনালয় কর্তৃক প্রণীত ও প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন তারিখ ১৫ নভেম্বর ২০০৬ নং ধর্ম/সংস্থা ৭-৩/২০০৪/৫০৭ মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালাকে সংশোধন ও পরিমার্জন করে ইমাম- মুয়াজ্জিনদের কল্যাণার্থে একটি সুন্দর যুগোপযোগী নীতিমালা তথা সার্ভিস রুলস প্রণয়ন করা।
২. মসজিদের ইমামদেরকে ১ম শ্রেণির নন ক্যাডার কর্মকর্তা, মুয়াজ্জিনদের ৩য় শ্রেণী, খাদিমদের ৪র্থ শ্রেণীর পদমর্যাদা দিয়ে প্রশাসনিক সরকারী কলেজ ও সকল প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান জনবলকে জাতীয়করণ করা। সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের অর্গানোগ্রামে মসজিদকে অন্তর্ভুক্ত করা।
৩. সরকারি অর্থের সাশ্রয় করার লক্ষ্যে মসজিদের ইমাম-খতিবকে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে খ-কালীন ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া।
৪. ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টকে এক হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করে ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ব্যাংক চালু করা।
৫. মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণ শিক্ষাকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত করা।
৬. মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনকে সাপ্তাহিক ২ দিন ছুটিসহ দুই ঈদে বোনাস প্রদান, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, সন্তানদের শিক্ষা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা।
৭. বেসরকারিভাবে সকল মসজিদে দ্রব্যমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শহরাঞ্চলে ইমামের মাসিক সম্মানী ৪০,০০০/, গ্রামে ২০,০০০/- মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের সম্মানী শহরে ২৫,০০০/-, গ্রামে ১৫,০০০/- থেকে ২০,০০০/- ধার্য্য করার নির্দেশনা প্রদান করা এবং সরকারীভাবে ৫০% বেতন প্রদান করা।
৮. প্রতিটি মসজিদে ইমাম-খতীব, মুয়াজ্জিনদের আপদকালীন সহযোগিতার লক্ষ্যে একটি ডিপিএস বা প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করা।
৯. দুর্ঘটনা সহ বা যেকোন দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনকে এককালীন ২,০০,০০০/- টাকা প্রদান করা।
১০. উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মাদকের করাল গ্রাস থেকে সমাজকে রক্ষায় শিক্ষার সকল স্তরে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
১১. মসজিদভিত্তিক যাকাত ও করযে হাসানা তহবিল গঠন করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে সুদের কষাঘাত থেকে বাঁচাতে এবং ধনী-গরীব বৈষম্যের দেয়াল ভেঙ্গে দিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি সিলেট জেলা শাখা