চন্দ্রজয়ের ইতিহাস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ৪:৩৯:২৬ অপরাহ্ন

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
একটা সময় চন্দ্র জয় ছিল কেবল নিছক অবাস্তব কল্পনা। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে প্রযুক্তির উৎকর্ষে দুঃসাহসী মানুষ সেই কল্পনাকেও হার মানিয়ে জয় করেছে চন্দ্রপৃষ্ঠ। মানুষ ছুটে চলছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। সেই ধারাবাহিকতায় মানুষ জয় করেছে মহাকাশ। চাঁদের বুকে একে রেখেছে পদচিহ্ন। বহু দেশ চাঁদের মাটিতে পা রাখার চেষ্টা চালিয়েছে। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন সফলভাবে চাঁদে যাত্রা করেছে। পৃথিবীর এই চন্দ্র জয়ের ইতিহাসে নতুন করে যুক্ত হলো ভারতের নাম।
১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর, পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার জন্য প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ হিসাবে স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর মাধ্যমে চাঁদের মাটিতে অবতরণের জন্য মহাকাশে যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। পৃথিবীর প্রথম প্রাণী হিসেবে লাইকা নামের এক কুকুরকে মহাকাশে পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬১ সালে প্রথম মানুষ ইউরি গ্যাগারিনকে মহাকাশে পাঠায় দেশটি।
চাঁদে অবতরণে সোভিয়েত ইউনিয়নের একের পর এক সাফল্যের পর ১৯৬৮ সালের ১১ই অক্টোবর পৃথিবীর কক্ষপথে অ্যাপোলো-৭ পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় কক্ষপথে থেকে ২২শে অক্টোবরে অ্যাপোলো-৭ ফিরে আসে। অ্যাপোলো-৭ এর সফলতার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম চন্দ্রাভিচানে মনুষ্যবাহী অ্যাপোলো ৮ পাঠানো হয়। এই অভিযানেই প্রথমবারের মত মানুষ পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে চাঁদের কক্ষপথে যেতে সক্ষম হয়। জেমস লোভেল, উইলিয়াম অ্যান্ডারসন এবং কমান্ডার ফ্রাংক বোর্মানকে নিয়ে ১৯৬৮ সালের ২১ ডিসেম্বরে অ্যাপোলো ৮ যাত্রা করে। চাঁদের চারপাশ ১০ বার অতিক্রম করে ২৭ ডিসেম্বর তা পৃথিবীতে ফিরে আসে। এরপর ১৯৬৯ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ওই বছরের ২০শে জুলাই প্রথমবার চাঁদের মাটিতে পা রাখে মানুষ। চাঁদে যাওয়া প্রথম মানুষ হলেন- আমেরিকার ২ নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন। এই মিশনের তৃতীয় নভোচারী মাইকেল কলিন্স চাঁদে নামেননি। চাঁদে নেমেই নীল আর্মস্ট্রং তো অবাক। চারদিকে সারি সারি পাথর আর বড় বড় গর্ত। চাঁদের বুক থেকে আর্মস্ট্রং শিলা সংগ্রহ করলেন, অসংখ্য ছবি তুললেন, স্থাপন করলেন আমেরিকার পতাকা। আর্মস্ট্রং চাঁদে নামার সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর অলড্রিনও নেমে আসেন। দুজনই দুই ব্যাগে করে নিয়ে আসেন সাড়ে ২১ কেজি ধুলোবালি পাথর ইত্যাদি। আর্মস্ট্রং প্রথমবারের মতো চাঁদের মাটিতে পা রেখে বলেছিলেন, ‘এটা (চাঁদের মাটিতে পা রাখা) একজন মানুষের জন্য ছোট একটা পদক্ষেপ হলেও মানব সভ্যতার জন্য অনেক বড় একটা পদক্ষেপ।’ ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ এর মধ্যে চাঁদের বুকে ছয়বার মানুষের অবতরণ ঘটে এবং মনুষ্যবিহীন অবতরণ ঘটে অসংখ্যবার। ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর চাঁদে অবতরণের রেকর্ড গড়ে চীনা নভোযান চ্যাঙ্গ-৩। সর্বশেষ ভারত ২০২৩ সালে চতুর্থ দেশ হিসেবে নাম লেখালো চন্দ্রজয়ের ইতিহাসে।
চন্দ্রাভিযান নিয়ে ভারতের আগ্রহ অনেক দিনের। বিশ্বের অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার মতো ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোও বেশ কটি অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে তাদের সঙ্গে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর আছে বিস্তর ফারাক। এটি কেবল গবেষণায় নয়; বাজেটেও। তবু কম বাজেটে ভারতের এমন সাফল্য ঈর্ষণীয়। ভারতের সাম্প্রতিক চন্দ্রাভিযান তারই যুতসই উদাহরণ। ভারতের চন্দ্রযান-৩ নামের একটি যান গত ১৪ জুলাই-২০২৩ চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেই মহাশূন্য যানটি কয়েকদিন চাঁদের কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায়। উদ্দেশ্য নিরাপদ অবতরণ। সেই লক্ষ্যে গত ২৩ আগস্ট ২০২৩ সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চন্দ্রযান-৩ চাঁদের রহস্যময় দক্ষিণ মেরুর বুকে অবতরণ করে। এটি ভারতের তৃতীয় চন্দ্র অভিযান। এর লক্ষ্য- চাঁদে পানির উপস্থিতি সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন। যদি পর্যাপ্ত পানির উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হবে চাঁদের অন্যতম মহামূল্যবান সম্পদ। চাঁদের যে অংশ নিয়ে মানুষের জানা বাকি, ছায়া বা অন্ধকারে ঢাকা যে অংশ, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের তেমন ধারণা নেই। চন্দ্রযান-৩ সফল অবতরণের মাধ্যমে ইতিহাস গড়ল ভারত। এর আগে ভারতের চন্দ্রযান ১ ও ২ নামে দুটি অভিযান ব্যর্থ হয়।
২
০১৯ সালে চাঁদের একই এলাকায় নিরাপদ অবতরণে ব্যর্থ হয় চন্দ্রযান-২। চাঁদে নামতে গিয়ে ২ দশমিক ১ কিলোমিটার আগেই ভারতের এ মহাকাশযানের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় একে দেশটির মহাকাশ অভিযানের ব্যর্থতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ২০০৮ সালেও চন্দ্রযান-১ প্রকল্পের মাধ্যমে চাঁদে প্রথম ছাপ রেখেছিল ভারত। কিন্তু সেবারও স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয় ভারত। চাঁদের একেবারে কাছে গিয়ে ইসরোর সঙ্গে চন্দ্রযান-১ এর (চন্দ্রযান বিক্রম) যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারের (২০২৩ সালের) চন্দ্রাভিযান সফল করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। এবারে চন্দ্রবিজয় করলো ভারত। চন্দ্রযান বিক্রম ঠিকঠাক অবতরণ করতে পারায় ভারতই হলো চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছানো প্রথম এবং চাঁদের বুকে সফলভাবে নামতে পারা চতুর্থ দেশ। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মহাকাশযান নিরাপদে চাঁদের মাটিতে অবতরণ করতে পেরেছিল।
তথ্যসূত্র: (বাংলাদেশ প্রতিদিন-২৪ আগস্ট ২০২৩, মাত্রা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স- সেপ্টেম্বর ২০২৩, কারেন্ট নিউজ- সেপ্টেম্বর ২০২৩)
লেখক: প্রাবন্ধিক