লন্ডনে বর্তমানে প্রজন্মের স্রোতধারা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ৫:০৪:২৩ অপরাহ্ন
সীতাব আলী
লন্ডনে চৌদ্দ দিন সফর করার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গেল একদম পারিবারিক কাজে। এবারের অভিজ্ঞতা বর্তমান প্রজন্মের লন্ডনমুখী ¯্রােতধারা দেখা ও জানার অভিজ্ঞতা! এ ¯্রােতধারা বড়ই বিচিত্র। ষাটের দশকে সিলেটী শিল্পী দুরবীন শাহ্ চমৎকার করে গেয়ে ছিলেন, “উঠলো রে লন্ডনের জ¦র, জাগাজমি বিক্রি কর, তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট কর, সময় বইয়া যায়।” অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ষাটের দশক আবার ফিরে এসেছে, মারাত্মক কিছু ব্যতিক্রম নিয়ে। আজ সেই ব্যতিক্রমটাই আলোচনার বিষয়।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে আমার কর্মস্থলের পাশেই নির্বানা ইন। সেখানে বিভিন্ন দেশের ভিসার জন্য আবেদন গ্রহণ করে একটি সংস্থা। এ বছরের শুরু থেকে এটির লন, পার্কিং-প্লেসসহ সব জায়গাতেই তরুণ তরুণীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো, হোক সে বৃষ্টি-বাদল অথবা কড়া রোদ। ভিসা-আবেদন জমা দেবার জন্যে যারা আসছেন, তাদের সাথীরা এভাবে অবহেলায় বসে সময় কাটাচ্ছেন।
যাচ্ছেন কেউ বা “স্টুডেন্ট ভিসা” নিয়ে, কেউ বা “কেয়ার ভিসা” নিয়ে। ওখানে গেলেই আপনি হাসিখুশি মুখ দেখবেন, আপনার মন জুড়িয়ে যাবে!
ব্রিটিশরা এবার দিলদরাজ হয়েছে ভিসা দেবার ব্যাপারে। আবেদন করলেই ভিসা, হউক যে প্রকারেরই। এবার বাড়তি সুযোগ, পরিবার নিয়ে যেতে পারবেন, হোন আপনি স্টুডেন্ট অথবা কেয়ারার। সাথে বাচ্চা আছে, নো চিন্তা, ভিসা হয়ে যাচ্ছে দেদারসে। শুধু আপনাকে ফিসটা গুণতে হবে, এই যা!
সিলেট শহরে এই কাজগুলো করার জন্যে গড়ে উঠেছে প্রচুর প্রতিষ্ঠান। তারাই কাজটি সম্পন্ন করে দেন। আপনি শুধু প্রয়োজনীয় কাগজ আর টাকাটা পরিশোধ করবেন। এই টাকার অংক এক নয়, নানা প্রতিষ্ঠান তাদের মতো করে রেট বসাচ্ছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই ভিড় লেগে আছে লন্ডন যাত্রীর। আসলে ব্রিটেন যাত্রীর। ব্রিটেন বলতে সিলেটের লোক লন্ডনকেই বুঝে। যেন লন্ডন মানে ব্রিটেন, ব্রিটেনের সব শহর। তো সেখানে যেতে কারো খরচ হচ্ছে ১৬/২০ লাখ টাকা, কারো বা ত্রিশ লাখ টাকা। হোক, তবু তো লন্ডন যাওয়া যাচ্ছে!
২০ অক্টোবর ব্রিটেনের বামিংহাম শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় আমন্ত্রণ। সেখানে দেখা হয়ে গেল সদ্য বিলাতপ্রবাসী আরেক আত্মীয় পরিবারের সাথে। মাত্র তিন মাস হলো, স্বামী-স্ত্রী তাদের দুই সন্তান নিয়ে চলে এসেছেন বাসার জমি বিক্রি করে। স্ত্রী ছাত্রী, তিনি আইএলটিএস এ যোগ্য হয়ে একটি বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ভিসা পেয়েছেন। সাথে তার স্বামী ও সন্তানদেরকে নিয়ে এসেছেন। তাদের সাথে কথা বল্লাম।
কেমন চলছে গো মা? এই দিয়ে শুরু। তারা সন্তানদেরকে ভর্তি করিয়েছেন স্থানীয় একটি স্কুলে। বল্লেন, “শিক্ষার্থী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায় ২০ ঘণ্টা। কাজ সুবিধামত পাওয়া বেশ কঠিন। স্বামীও কাজের তেমন সুযোগ করতে পারেননি। এক জায়গায় কাজ করতে গিয়ে স্পিডের কারণে ফেরত এসেছেন। এদেশের গতির সাথে বাংলাদেশের ধীরগতি চলে না।” বলতে থাকলেন, “ঘর ভাড়া দিতে হয় এক হাজার পাউন্ড, মানে বাংলাদেশের এক লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা। আর খাবারদাবার এবং বাচ্চাদের ও নিজের হাতখরচ তো আছেই। চলছে না। দেশ থেকে আরো কিছু টাকা আনতে হচ্ছে। এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় কোন রকমে ঠিকে আছি সোনালী ভবিষ্যতের আশায়।”
আমি সান্ত¦না দিলাম, বারো বছরের বিদেশের অভিজ্ঞতা আমার! প্রথম দু‘তিন বছর একটু কষ্ট সহ্য করে টিকে যেতে পারলে, তুমি টিকেই গেলে। অবএব ধৈর্য ধরতে হবে, আমরা তোমাদের জন্যে দোয়া করবো।
লন্ডনে দেখা হলো আরেক শিক্ষার্থীর সাথে। সে একা এসেছে। প্রথমে বিশ^বিদ্যালয়ের পাশেই ঘর পেয়ে ছিল, কিন্তু তাকে মাসিক ভাড়া গুণতে হতো আটশ’ পাউন্ড, অর্থাৎ বাংলাদেশি লক্ষাধিক টাকার উপরে। খাবারদাবার নিজের। সাথে নিয়ে যাওয়া টাকা ও আত্মীয়দের গিফ্ট, এগুলোতে আর ক’দিন চলে। এখন এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছে, কিন্তু সেমিস্টার ফি’র জন্যে টাকা ধার করতে হয়েছে। কর্ম-ঘণ্টা ২০, মানে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে। কাজও বিচিত্র, যা দেশে এগুলো সে কখনো করতো না। তাকে আমি কি সান্ত¦না দেব, খুঁজে পাই নি।
আমার আরেক আত্মীয় অল্ডহামে এসে ছিল আমাদের বাসায়। সে ব্রিটেন গেছে ৩ মাস হলো, কেয়ার ভিসা, মানে একটু কেয়ার করতে হবে সোজা কথায় একটু দেখাশোনা করতে হবে। তাকে পাঠিয়েছে যারা তারা বলেছিল, গিয়ে কাজ পাবে ৩৯ ঘণ্টা। কোম্পানি খুবই ভালো। খরচ হয়েছে প্রায় বিশ লক্ষ টাকা।
সে তার মামার বাড়ি গেছে। মামা তার রেস্টুরেন্টে থাকতে দিয়েছে। কোম্পানির সাথে প্রথম যোগাযোগেই কোম্পানি তাকে নিজের মানুষ বলে অস্বীকার করলো। পরে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর এখন বলছে, আগে কেয়ারার ট্রেনিং শেষ করো, পরে কাজ হবে। এখনো এক ঘণ্টা কাজ পায়নি সে। মামার হোটেলে আছে, লুকিয়ে চুরিয়ে যা কাজ করা যায়, এরকম চলছে।
আমি বল্লাম, তোমার ভাগ্য ভালো, মামা ছিল বলে। যাদের মামা, চাচা, খালা, বোন-ভাই নাই তাদের কি অবস্থা! তাদের কেউ কেউ মসজিদে নাকি থাকছে, এর ওর বাসায় দুুদিন থেকে আবার অন্যত্র দৌড়াচ্ছে।
আমার আত্মীয়রা অনেক কাহিনি বল্লেন, যার কোনটাই আনন্দের নয়।
এ নিয়ে এখন ব্রিটেন ও আমেরিকার পত্রপত্রিকা যেমন সরব, তেমনি আমাদের দেশের পত্রিকাগুলোও কম সরব নয়, এবং সুধীজনরাও তাদের আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে আসছেন।
বিগত ৪ নভেম্বর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শহীদ আল বোখারী মহাজাতক হাজার মানুষের সামনে অনলাইনে এ নিয়ে চমৎকার একটি আলোচনা তুলে ধরেন। নানা তথ্য উপাত্ত ও প্রমাণসহকারে এ আলোচনায় তিনি বলেন, “—আসলে ইউরোপ আমেরিকার বিশ^বিদ্যালয়গুলোর জন্যে বিদেশি শিক্ষার্থীরা হলো দুধেল গাই। যত বেশিসংখ্যক স্টুডেন্ট আকৃষ্ট করা যায় তত মুনাফা।
“২০২১ সালে আমেরিকায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী পড়তে গেছে যা তাদের অর্থনীতিতে যোগ করেছে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। একই বছর কানাডা গাড়ি, গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ ও বিমান রপ্তানি করে যত ডলার উপার্জন করেছে, তার চেয়ে বেশি আয় করেছে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে, ২২ বিলিয়ন ডলার!
“আর ইংল্যান্ড বিদেশি শিক্ষার্থীদের থেকে টিউশন ফি ও আনুষঙ্গিক ফি বাবদ ৫২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
“—গত চার অক্টোবর থেকে তারা বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা ফি হেলথ ইনস্যুরেন্স ফি ইত্যাদি বাড়িয়েছে। বাড়ানোর কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত ১০০ কোটি পাউন্ড আদায় করা।”
আর ইদানীং পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে জন্মহার কমছে, তাই তাদের দেশগুলোতে শ্রমিক দরকার।
কিন্তু এই মুহূর্তে হঠাৎ করে একটি বিশেষ বিভাগে শ্রমিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় নতুনদের অধিকাংশই বেকার।
কেয়ার ভিসায় লোক আনতে কোন কোন কোম্পানি তাদের শ্রমিক-সংখ্যার যে অনুমোদন সরকার থেকে পেয়েছে, তারা তার থেকে বহুগুণ বেশি লোক বিদেশ থেকে নিয়ে গেছে টুপাইস কামানোর লোভে। অতিসম্প্রতি বিবিসি একটি সরেজমিন প্রতিবেদন করেছে যে একটি কোম্পানি মাত্র ৭জন শ্রমিক বিদেশ থেকে আনতে পারার অনুমোদন পেয়েছিল, সে স্থলে তারা ৪৭ জনকে নিয়ে এসেছে। এখন ৭ জনের কাজ ৪৭ জন করবে।
প্রবাস যাত্রাকে আমরা কোনভাবেই নিরুৎসাহিত করছি না। শুধু যাবার আগে ভালভাবে দেখেশুনে যাচাই করে যান। বাষট্টি সাল আর দু’হাজার তেইশ ষাল এক নয়। বাষট্টি সালে ব্রিটেনে শ্রমিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। সদ্যসমাপ্ত দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর হিটলারের বিধস্থ করা ব্রিটেনকে আধুনিক করে গড়ে তোলার জন্যে ব্রিটেনে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। লোকজন বিলেত গিয়েই কাজে লেগে গেছে। এখন পরিস্থিতি সেরকম নয়। তখন যে কেউ যে কোন কাজ করতে পারতো কিন্তু এখন কেয়ার ভিসার লোক শুধু কেয়ারার হিসেবেই কাজ করবে, অন্য কিছু নয়। অন্য কিছু করা বেআইনি, আর তার শাস্তি হতে পারে ভিসা কেটে নিজ দেশে ফেরৎ পাঠানো। তাই বিদেশে যাবার আগে অবশ্যই যাচাই বাছাই করে যান, ভালো থাকুন।
লেখক: কলামিস্ট, মুক্তিযোদ্ধা; পরিচালক, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সিলেট সেন্টার।