অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
প্রবেশ মুখে জুতার দোকান ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৪৮:৪২ অপরাহ্ন
দুইদিনের মধ্যে পরিষ্কার করা হবে ॥ মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী
আহমাদ সেলিম :
সাজিয়ে রাখা জুতার সারি দেখে বোঝার উপায় নেই-এর পেছনে থাকা বিদ্যালয়টি সিলেটের একটি আলোকিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর সেই বিদ্যালয়ের নাম সিলেট অগ্রগামী বালিকা উচ্চা বিদ্যালয় ও কলেজ। স্বনামধন্য এ প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ পথটি এভাবে জুতা দিয়ে সাজিয়ে রাখাটাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বর্তমান, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবক এমনকি সিলেটের সুশীল সমাজ। অনেকে বিষয়টিকে বিদ্যালয়কে ‘অবমাননার
শামিল’ হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে শিক্ষার মর্যাদার জায়গা ব্যাহত হচ্ছে।
সিলেটে নারী জাগরণের সূতিকাগার হিসেবে গণ্য হয় প্রাচীন বিদ্যাপীঠ অগ্রগ্রামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজটি। সেই বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকটি শিক্ষার্থীদের কাছে গভীর আবেগের। প্রতিদিন সকাল হলে পবিত্র মনমানসিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে জ্ঞান আহরণে প্রবেশ করে।
তারপর বিকেল বেলা ছুটির আগ পর্যন্ত সেখানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াতে হয় অভিভাবকদের। পুরো বিদ্যালয় যখন ফাঁকা হয়ে যায় ঠিক তখন, অর্থাৎ সন্ধ্যার আগ থেকে এভাবেই জুতার সারি দিয়ে ফটকটি ডেকে দেয় ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। আর সেই দৃশ্যটি আঘাত করছে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সুশীল সমাজ এমনকি সাধারণ মানুষকেও।
বিদ্যালয়ে ষষ্ট শ্রেণিতে পড়–য়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ডা. দিলীপ দাস। বেশ কয়েকদিন ধরে তিনি দৃষ্টিকটু বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। তার সাথে একমত পোষণ করে এগিয়ে এসেছেন বিদ্যালয়ের আরো অন্তত চল্লিশজন অভিভাবক। তারা দৈনিক সিলেটের ডাকের বার্তা কক্ষে এসে অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ের সামনে জুতার অস্থায়ী দোকানগুলো বর্তমানে অনেকটা স্থায়ী দোকানে রুপ নিয়েছে। বারবার বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আমরা বিষয়টি অবগত করেছি। এমনকি ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের সাথেও কথা বলেছি। কিন্তু কেউ কথা শুনছেন না।
তারা বলেন, এই বিদ্যালয়ের সাথে সিলেটের মানুষের আবেগ, অনুভূতি জড়িয়ে আছে। শিশুদের সুন্দর বিকাশের একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু পরিবেশটা নষ্ট করে ফেলছে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। স্কুল ছুটির পর দিনের বেলাতেই তারা জুতা দিয়ে পুরো গেইট ডেকে ফেলে।
একই বিদ্যালয়ের অভিভাবক আশরাফ বলেন, ‘কয়েকদিন আগে কলকাতা থেকে এই বিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী এসেছিলেন সিলেটে। সন্ধ্যার পর তাকে নিয়ে আমি গিয়েছিলাম স্কুলে। কিন্তু জুতার দোকান দেখে আমরা হতবাক হয়েছি। এমনভাবে জুতা সাজিয়ে রাখা হয়েছে, গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তোলার পরিবেশটাও খুঁজে পাইনি। স্মৃতি কুড়াতে এসে অনেকটা হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে সেই অতিথিকে।’
১৯০৩ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই কনক পুরকায়স্থ ঊষা থেকে শুরু করে সিলেটের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এর বোন, খ্যাতিমান চিকিৎসক, জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন এর মতো প্রজ্ঞাদীপ্ত মানুষও এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। যারা দেশে-বিদেশে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছেন। সেই বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের এমন চিত্র, আহত করছে অনেককে।
বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক জানান, বিদ্যালয় ছুটির পরপরই, সন্ধ্যার আগেই এভাবে প্রতিদিন জুতা সাজিয়ে তারা বসে পড়ে। অনেকদিন আমাদেরকে ভেতরে রেখেই তারা দোকান সাজাতে গেইট বন্ধ করে দেয়। এর পেছনে আশপাশ এলাকার কিছু মানুষ জড়িত রয়েছে। তাদের মদদেই ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা এমন দু:সাহস দেখাতে পারছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মমতাজ বেগমের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
সরকারি মদনমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কবি হোসনে আরা কামালী বলেন, সিলেটের কোনো ফুটপাতই মানুষের চলাচলের উপযোগী নয়। অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজটির বাইরের পরিবেশ মেনে নিতে কষ্ট হয়। তিনি বলেন, এটি মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাদের শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা প্রশাসন থেকে শুরু করে সবার নৈতিক দায়িত্ব। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখ ফুলবাগানের মতো সুন্দর রাখা প্রয়োজন ছিলো। সেখানে এ ধরণের জুতার দোকান কোনোভাবে কাম্য নয়।’
সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শামীমা চৌধুরী বলেন, আমরা এই দৃশ্য কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এটি শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, সিলেটের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু, বিদ্যালয়ের সম্মুখভাগ দেখে শুধু বাজার মনে হচ্ছে না, সেই সাথে আমাদের দায়িত্বহীনতার বিষয়টিও ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, বিদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে যেভাবে নান্দনিক ভাব থাকে, সেভাবে বাইরের অংশটিও থাকে চমৎকার। সেই সুন্দর পরিবেশ শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে ব্যাকুল করে তুলে। আমাদের উচিত হবে স্থায়ীভাবে এর সমাধান। আজ অভিযান চালানোর পর কাল আবার তারা বসে পড়বে-এমনটি করলে হবে না। এতে শিক্ষার মর্যাদার জায়গাটির প্রতি অসম্মান দেখানো হবে। যোগাযোগ করা হলে অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, বিষয়টি আমি দেখছি। তবে দুই-এক দিনের মধ্যে বিদ্যালয়ের সম্মুখ থেকে সব ধরণের ফুটপাত সরানোর কথা বলেছেন সিলেটের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেছেন, আশেপাশের পরিবেশ সুন্দর করা হবে।