“সিলেট জেলার উপজেলাসমূহের বিনিয়োগ সম্ভাবনা”
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ৫:৩৯:২৭ অপরাহ্ন
ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল
জৈন্তাপুর উপজেলার বিনিয়োগ সম্ভাবনা : সিলেট শহর হতে ৪০ কি.মি. দূরে জৈন্তা-খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে জৈন্তাপুর উপজেলা অবস্থিত। জৈন্তাপুর উপজেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিনে কানাইঘাট উপজেলা ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে কানাইঘাট উপজেলা, পশ্চিমে গোয়াইনঘাট উপজেলা ও সিলেট সদর উপজেলা। উপজেলায় ইউনিয়নের সংখ্যা ৬টি। ইউনিয়নগুলো হলো- নিজপাট, জৈন্তাপুর, চারিকাটা, দরবস্ত, ফতেহপুর, চিকনাগুল। জৈন্তাপুর উপজেলার আয়তন ২৫৮.৬৯ বর্গ কি.মি। জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৭০ জন। শিক্ষার হার ৩৫.১১%। এখানে রয়েছে শ্রীপুর পাথর কোয়ারি, লালাখাল চা বাগান, তামাবিল বন্দর। উপজেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। কৃষির সাথে জড়িত ৫৩.৮৩% জনগন।
জৈন্তাপুর উপজেলার মূলত ধান, চা, আলু, তেজপাতা, পান ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে কাঠাল, আনারস, বাদাম উৎপন্ন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস, পাথর, চুনাপাথর জৈন্তাপুরে পাওয়া যায়। পাকা রাস্তার পরিমান ২২৪ কিলোমিটার। জৈন্তাপুর উপজেলার ৫টি কলেজ, ১৩টি মাধ্যমিক স্কুল, ৫৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২৩ টি মাদ্রাসা রয়েছে। এলাকার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে হাস মুরগীর খামার এবং ডেইরী ফার্ম রয়েছে এবং আরও নতুন নতুন খামার, ডেইরী ফার্ম গড়ে তোলা সম্ভব। জৈন্তাপুরে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমানে ঘাস পাওয়া যায়। এখানে প্রচুর পরিমান খালি জায়গা রয়েছে এবং আবহাওয়া ভালো এবং মাটির উর্বরতা ভালো। গবাদীপশুর খাবার সহজেই উৎপাদন করা সম্ভব এবং বৃহৎ আকারের ডেইরী ফার্ম করা যেতে পারে। হরিপুরে সিরামিক তৈরীর উপযোগী মাটি রয়েছে। এ ধরনের মাটিকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে হরিপুরে সিরামিক ফ্যাক্টরী গড়ে তোলা সম্ভব হবে। জৈন্তাপুরের হরিপুর এলাকাসহ বেশ কিছু এলাকায় পতিত জমি আছে এবং সে সকল এলাকায় মৎস্য খামার এবং হ্যাচারী করা সম্ভব।
উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নে টিলা এবং উচুঁস্থান রয়েছে যেখানে রাবার বাগানের মাধ্যমে রাবার উৎপাদন সম্ভব। শ্রীপুর চা বাগান, রং পানি গ্রাম, মোকামবাড়ী গ্রাম, খাসিয়া পল্লী ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তাছাড়াও সিলেটের অন্যতম টুরিস্ট স্পট লালখালকে কেন্দ্র করে হোটেল, রিসোর্ট হতে পারে। জৈন্তাপুরের চিকনাগুলে ইকো ফ্রেন্ডলী ব্রিক উৎপাদন করা যেতে পারে। চিকনাগুল ও হরিপুর এলাকায় গ্যাসের ও তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মজুদ গ্যাস ও তেল আহরণ করা সম্ভব। হরিপুরের ও চিকনাগুলের গ্যাস আহরণ করা সম্ভব হলে গ্যাস ব্যবহারের মাধ্যমে পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরী করা যেতে পারে এবং জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করা সম্ভব হতে পারে। তাছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় সোলার প্ল্যান্ট করা সম্ভব হতে পারে।
জৈন্তাপুরের নিজপাট ইউনিয়নে প্রচুর পরিমাণ বালু পাওয়া যায়। এসকল বালু গ্লাস তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে গ্লাস ফ্যাক্টরী তৈরী করা এবং এর মাধ্যমে গ্লাস উৎপাদন করা সম্ভব। জৈন্তাপুরের বিস্কুট ও কেক তৈরীর ফ্যাক্টরী এবং মিষ্টির ও দই তৈরীর ফ্যাক্টরী করা সম্ভব। সারি নদী জৈন্তাপুরের প্রধান নদী। সারিঘাটের কাছে তরমুজের বাগান রয়েছে। মোট এলাকার প্রায় ১৫% টিলা অথবা পাহাড় বেষ্টিত এবং বাকী ৮৫% এলাকা সমতল ভূমি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত জৈন্তাপুর উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত এবং পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে। জৈন্তাপুর উপজেলার কিছু কিছু স্থানে রাস্তার অবস্থা ভালো নয়। শিক্ষার হার কম হওয়া এবং কাঁচামাল পরিবহন সমস্যা জৈন্তাপুর উপজেলার সমস্যা। জৈন্তাপুরের বিভিন্ন খামারে জনবলের স্বল্পতা দেখা যায়। জৈন্তাপুর উপজেলার জনগোষ্ঠীর মাঝে অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্রতা পরিলক্ষিত হয়। এ উপজেলার প্রবাসীগণের মাঝে প্রায় ৯৫% মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন এবং ৫% প্রাবাসী ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, পর্তুগাল, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। জৈন্তাপুরে ক্লিনিক এবং ডায়াগনষ্টিক সেন্টার করা সম্ভব।
সম্ভাব্য বিনিয়োগের খাত/সম্ভাব্য উৎপাদনঃ
ডেইরী ফার্ম, হাঁস-মুরগীর খামার, মৎস্য খামার ও হ্যাচারী, সিরামিক ফ্যাক্টরী, পর্যটন খাত, রাবার উৎপাদন, ইট উৎপাদন, পাওয়ার ও সোলার প্ল্যান্ট, গ্লাস ফ্যাক্টরী, মিষ্টি, দই, কেক, বিস্কুট উৎপাদন, আলু, তেজপাতা, পান, কাঠাল, আনারস, বাদাম, তরমুজ চাষ/উৎপাদন। ক্ষেত্র বিশেষে ফিজিবিলিটি টেস্ট প্রয়োজন।
জকিগঞ্জ উপজেলার বিনিয়োগ সম্ভাবনা :
জকিগঞ্জ উপজেলা বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব কোনের সর্বশেষ উপজেলা। জকিগঞ্জের আয়তন ২৬৭ বর্গ কি. মি. এবং জনসংখ্যা প্রায় ২ লাভ ৫০ হাজার। জনসংখ্যার ঘনত্ব ৮৯০ বর্গ কিলোমিটার। জকিগঞ্জের উত্তরে কানাইঘাট উপজেলা ও ভারতের মেঘালয়, পূর্ব ও দক্ষিণে ভারতের আসাম, পশ্চিমে বিয়ানীবাজার উপজেলা। জকিগঞ্জ উপজেলার ইউনিয়নের সংখ্যা ৯টি এবং পৌরসভা ১টি। উপজেলায় উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ৭টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২২টি, প্রাথমিক বিদ্যালয় ১০৭টি এবং মাদ্রাসা ৫৭ টি রয়েছে।
জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি এবং কৃষির সাথে জড়িত রয়েছেন উপজেলার ৪৬.০৬% জনগন। সব কয়টি ইউনিয়ন পল্লী বিদ্যুৎ কর্মসূচীর আওতাধীন। তিন নদীর মোহনা আমলশীদ, মরিচা বাগানবাড়ী উপজেলার দর্শনীয় স্থান। দুধের এবং গরুর মাংশের চাহিদা বেশী হওয়ার কারণে এবং প্রাকৃতিক ঘাসের প্রাচুর্যতা থাকার ফলে এবং ঘাস উৎপন্ন করা সম্ভব হবার ফলে উপজেলার বারহাল ইউনিয়ন, কসকনকপুর ইউনিয়নসহ অন্যান্য স্থানে ডেইরী ফার্ম দেয়া সম্ভব। জকিগঞ্জের সব ইউনিয়নেই গরুর খামার দেয়া সম্ভব।
জকিগঞ্জে ছাগল এবং ভেড়ার খামার দেয়া সম্ভব। হাস-মুরগীর খামার বৃদ্ধি করা যেতে পারে। হাঁস-মুরগীর খামার দেবার মত জনবল জকিগঞ্জ রয়েছে। জকিগঞ্জের হাওর ও নি¤œ অঞ্চলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। মৎস্য আহরণ বৃদ্ধি করা এবং মৎস্য খামার দেয়া জকিগঞ্জে লাভজনক হবে বলে আশা করা যায়। জকিগঞ্জ ফিশ প্রসেসিং প্ল্যান্ট দেয়া সম্ভব হলেও সিলেট থেকে দূরত্বের কারণে পরিবহন ব্যয় বেশী হবে। মানিকপুর ইউনিয়ন, কসকনকপুর ইউনিয়ন ও বারোঠাকুরী ইউনিয়নে সোলার প্ল্যান্ট দেয়া সম্ভব হতে পারে এবং এ অঞ্চলগুলোতে সমতল ভূমি রয়েছে। মানিকপুর ইউনিয়নের কালিগঞ্জ বাজারে বিস্কুট, কেক, দই, মিষ্টি প্রভৃতি উৎপাদনকারী কারখান হতে পারে।
এছাড়াও কালিগঞ্জে স্টিল নির্মিত আলমারী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। মানিকপুর ইউনিয়নের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। ভারতের সুতারকান্দি থেকে আমদানীকৃত কয়লার ব্যবহারের মাধ্যমে এবং পাশ^বর্তী ভারতের সেভেন সিস্টারের মার্কেট টার্গেট করে জকিগঞ্জে সিরামিক ফ্যাক্টরী প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। জকিগঞ্জ পৌরসভায় বেসরকারী উদ্যোগে হাসাপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়গনস্টিক সেন্টার হতে পারে। বারোঠাকুরী ইউনিয়নে প্রচুর পরিমান টমেটো, শীম, পটল প্রভৃতি উৎপন্ন হয়।
সিলেট থেকে দূরত্বের কারণে এবং গ্যাস সংযোগ না থাকার ফলে আপাতত ফুড প্রসেসিং প্ল্যান্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। জকিগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো এবং জনগনের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। সিলেট থেকে জকিগঞ্জের দুরত্ব বেশী হবার ফলে পন্যের পরিবহন খরচ বেশী হয়ে যায়। অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ জকিগঞ্জের একটি বড় সমস্যা। জকিগঞ্জের অনেক এলাকায় দরিদ্র শ্রেনীর জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে এবং শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে কম। গ্যাসের সংযোগ না থাকার ফলে বড় পরিসরে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
জকিগঞ্জের প্রবাসীগণের মাঝে প্রায় ৭০% প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, যেমন সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান ইত্যাদি দেশে অবস্থান করছেন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগালসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং আমেরিকা, কানাডা ইত্যাদি দেশে অবস্থান করছেন প্রায় ৩০% প্রবাসী। জকিগঞ্জের বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে নি¤œ অঞ্চল। এসকল এলাকায় ধান উৎপাদন এবং মৎস্য আহরণ করা হায় থাকে। অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নতির সাথে সাথে জকিগঞ্জের জনগন সিলেট শহরে আসতে বেশী আগ্রহী।
সম্ভাব্য বিনিয়োগের সম্ভাব্য উৎপাদন :
ডেইরী ফার্ম ও গরুর খামার , মৎস্য খামার, হাঁস-মুরগীর খামার, ছাগল ও ভেড়ার খামার, স্টিল নির্মিত আলমারি, সোলার প্ল্যান্ট, মিষ্টি, দই, বিস্কুট ও কেক উৎপাদন, সিরামিক ফ্যাক্টরী, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সব্জি উৎপাদন। ক্ষেত্র বিশেষে ফিজিবিলিটি টেস্ট প্রয়োজন। (চলবে)