জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার আব্দুল মালিক আর নেই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ৪:২৪:০৭ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসার জনক, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক আর নেই। মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে বার্ধক্যজনিত কারণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। বুধবার সকালে সড়কপথে তাঁর লাশ সিলেট এসে পৌঁছুবে। বেলা ১১টায় সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল প্রাঙ্গণে এবং বাদ আসর গ্রামের বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কুচাই পশ্চিমপাড়া (নয়াগাঁও) গ্রামে নিজের উদ্যোগে তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত সৈয়দা নুরুন্নেছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ও সাবেক ব্যাংকার জালাল উদ্দিন তাজ। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, একমাত্র কন্যা ও দুই পুত্রসহ অসংখ্যা আত্মীয় স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর একমাত্র কন্যা প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ফজিলা-তুন-নেছা মালিক, এক পুত্র মোঃ মাসুদ মালিক ব্যবসায়ী এবং দ্বিতীয় পুত্র মনজুর মালিক কানাডায় গবেষণা কর্মে নিয়োজিত।
এর পূর্বে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় তাঁর তিনটি নামাজে জানাজা অনু্িষ্ঠত হয়। তিনি দীর্ঘদিন থেকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে হৃদরোগের চিকিৎসা প্রদান করায় সকল মহলে ‘মানবিক চিকিৎসক’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। তাঁর মৃত্যুতে সিলেটের চিকিৎসক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। সিলেটের কৃতিসন্তান মরহুম ডা. আব্দুল মালিক বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হৃদরোগ চিকিৎসার জনক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হৃদরোগ বিভাগ চালু হয়। পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে ও বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি চিকিৎসা সম্পন্ন হয় তাঁর উদ্যোগে। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৭৮ সালে ঢাকায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ১৯৭৮ সালে চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষদের নিয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ৪৩টি এফিলিয়েটেড বডির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হৃদরোগের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। ২০০৪ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার পান এবং ২০০৬ সালে জাতীয় অধ্যাপক পদে ভূষিত হন। ২০০১ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী : প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক ১৯২৯ সালের ১ ডিসেম্বর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই ইউনিয়নের পশ্চিমভাগ (নয়াগাঁও) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম ফুরকান আলী ও মাতা মরহুমা সৈয়দা নুরুন্নেছা খাতুন। শিক্ষা জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৪৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় পুরো দেশের মধ্যে ১১তম স্থান অর্জন করেন তিনি।
১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান আর্মি মেডিকেল কোরে যোগ দেন। পরে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত গমন করেন এবং হৃদরোগ চিকিৎসায় উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ১৯৭০ সালে মিলিটারি হসপিটাল ও আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ রাওয়ালপিন্ডিতে শিক্ষক ও কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ চাকুরি জীবনে তিনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসায় ব্যাপক অবদান রেখে ১৯৮৯ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদ থেকে অবসরে যান। পরে তিনি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অনারারী মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তিনি বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটি, সার্ক কার্ডিয়াক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক্সপার্ট প্যানেল কমিটি অন কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ এর সদস্যসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ২০১০ সালে তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, বাংলাদেশ ল্যাং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ সোসাইটি অফ মেডিসিন, এসোসিয়েশন অব ফিজিশিয়ান অব বাংলাদেশ এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ে ইউনাইটেড ফোরাম এগেইন টোবাকো গঠিত হয়। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রশংসিত হয়। তাঁর লেখা প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫টি।
তিনি ২০১২ সালে রাগীব-রাবেয়া একুশে সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে নিরলস পরিশ্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১৪’ পুরস্কার, ২০১৮ সালে ড. মোঃ ইব্রাহীম স্মৃতি স্বর্ণপদক সহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পদকে ভূষিত হন।
বিভিন্ন মহলের শোক
সিলেটের এ কৃতিসন্তানের মৃত্যুতে চিকিৎসক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সর্বস্তরের মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন। পৃথক শোকবার্তায় তাঁরা মরহুমের জীবনের বিভিন্ন দিক স্মরণ করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাশাপাশি মানবকল্যাণে তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করে তাঁর মৃত্যুতে সিলেটের তথা দেশবাসীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তারা রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
ড. এ কে আব্দুল মোমেন : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ ডা. আব্দুল মালিক ছিলেন একাধারে একজন সফল চিকিৎসক, খ্যাতনামা শিক্ষক এবং সমাজসেবক। বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী : সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এক শোকবার্তায় বলেন, তিনি সিলেট তথা বাংলাদেশের চিকিৎসাখাতের একজন পথপ্রদর্শক ছিলেন। মানবহিতৈষী কর্মকান্ডের জন্য তিনি নানাভাবে পুরস্কৃত এবং প্রশংসিত হয়েছেন। বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দানবীর ড. রাগীব আলীর শোক : বাংলাদেশের হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সিলেটের কৃতিসন্তান, জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিকের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অসংখ্য স্কুল-কলেজ ও মসজিদ-মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান দানবীর ড. রাগীব আলী। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, বাংলাদেশের হৃদরোগ চিকিৎসায় তিনি ছিলেন অগ্রদূত। তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি শুধু একজন প্রখর মেধার অধিকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন চিকিৎসাখাতের একজন দক্ষ সংগঠক। তার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ল্যাং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটি, সার্ক কার্ডিয়াক সোসাইটিসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। যার সুফল পাচ্ছেন দেশের অগণিত সাধারণ মানুষ। একজন সফল চিকিৎসক হওয়ার পাশাপাশি তিনি শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক ছিলেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। হৃদরোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসাক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ অবদান মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। ড. রাগীব আলী মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
মকসুদ ইবনে আজিজ লামা : জাতীয় পার্টির নেতা ও সিলেট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মকসুদ ইবনে আজিজ লামা জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব:) এম এ মালিকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব:) এম এ মালিকের মৃত্যুতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। যা সহজে পূরণ হবার নয়।
সিলেট প্রেসক্লাব : সিলেট প্রেসক্লাব সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ রেনু এক শোকবার্তায় বলেন, ডা. আব্দুল মালিক বাংলাদেশের হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ ছিলেন। একাধারে তিনি একজন সফল চিকিৎসক, খ্যাতনামা শিক্ষক এবং সমাজসেবক। বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসায় তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আরিফুল হক চৌধুরী : সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একাধারে তিনি একজন সফল চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ : জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) ডাঃ আব্দুল মালিক এর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সকল শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোঃ আবেদ হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ১৩৯তম একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এ বিষয়ে এক শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। শোক বার্তায় জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোঃ আবেদ হোসেন বলেন, জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) ডাঃ আব্দুল মালিক চিকিৎসক সমাজের একজন অভিভাবক ছিলেন, তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। তিনি ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক বিরল প্রতিভা।
মুহাম্মদ মুনতাসির আলী : খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মুনতাসির আলী জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব:) এম এ মালিকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। এছাড়া, জেলা খেলাফত মজলিসের সভাপতি মাওলানা নেহাল আহমদ ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ দিলওয়ার হোসাইন তার মৃত্যুতে অনুরূপ বার্তায় শোক প্রকাশ করেছেন।