কেন এ নিঠুর খেলা!
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ৯:৩২:১২ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস :
বিশেষ কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে পাঁচ বছর পর পর বাংলাদেশে নির্বাচনী হাওয়া বিরাজ করে। সেই হাওয়া প্রায় সময়ই উৎসবের চেহারা ধারণ করে। তবে নির্বাচন এলেই বিশ্বের পরাশক্তি অযাচিত হস্তক্ষেপ আর ঘন ঘন আনাগুনা-আসা-যাওয়া-কখনো কখনো উৎসবে মলিনতার ছাপ রেখে যায়।
বাংলাদেশের মতো অতিনগণ্য ছোট্ট একটি দেশে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবাই আদাজল খেয়ে যেন এক নীরব যুদ্ধে নেমে যান। বিশেষ করে আমেরিকা আর ইইউ ভুক্ত দেশগুলোর তৎপরতার কথা উল্লেখযোগ্য। আর সে কারণেই হয়তো গণতন্ত্র আর মানবাধিকার রপ্তানির কাজটি পুরোদমেই আমেরিকা করেই চলছে। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু কিছু বেরসিক অন্য কায়দায় কথা বলেন। যেমনটি বলেছেন, আমেরিকার কলামিস্ট ও লেখক বিলভন।
তিনি বলেছেন- ‘আমেরিকার নাগরিকরা অন্যদেশে গণতন্ত্র রপ্তানি করার জন্য প্রয়োজন হলে সাগর পেরিয়ে সেদেশে যুদ্ধ করবে। কিন্তু নিজের দেশে রাস্তা পেরিয়ে ভোট দিতে যাবে না।’
আমেরিকার লেখকই যদি এ কথা বলে থাকেন তাহলে বাংলাদেশের ভোট নিয়ে তাদের এতো মাতামাতি কেন সে প্রশ্নটি করতে বড়োই ইচ্ছে হয়।
বাইডেন সাহেবের নিযুক্ত পিটার হাস ক’দিন ধরে এমন আচরণ করছেন যেন তিনিই বাংলাদেশের নির্বাচন সহ সব কিছুরই নিয়ন্ত্রক। ১৩.১১.২০২৩ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার ৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম দেখলেই বাইডেন সাহেবের প্রকৃত চেহারা ফুটে উঠবে। এখানে আমাদের কোন বক্তব্য নয় স্বয়ং মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেবের।
এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন- যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্বের ভয়াবহ এ পরিস্থিতির জন্য জো বাইডেনই দায়ী। অনেকে বলেন বর্তমান বিশ্বের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বড় হুমকি। কিন্তু ট্রাম্প বলেন, উষ্ণায়ন নয় পারমাণবিক উষ্ণায়নই এর জন্য দায়ী। জো বাইডেনকে উদ্দেশ্য করে সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের এমন একজন ব্যক্তি আছেন, যিনি প্রধান সমঝোতাকারী, অথচ পারমাণবিক অস্ত্র কী তিনি তা ভালোভাবে জানেন না। আজকের বিশ্বের এমন খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে উদ্দেশ্য করে এবং দায়ী করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেব আরো বলেন, আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের একজন অযোগ্য নেতা আছেন, তিনি মঞ্চ থেকে নামতে পারেন না, সিঁড়ি খুঁজে পান না। তিনি দু’টি বাক্য এক সঙ্গে বলতে পারেন না। এমনকি কথাও বলতে পারেন না।’
স্প্যানিশ-আমেরিকান আউটলেট ইউনিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বর্তমান প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে যেসব উক্তি করেছেন এর উত্তরে জো বাইডেন সাহেব কি ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা আমরা জানতে পারিনি কিন্তু তবে অবশ্যই বাইডেন সাহেব ট্রাম্প সাহেবকে ভূয়সী প্রশংসা করেননি।
তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার শীর্ষ দুই নেতার যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এমনি হয় তাহলে এর প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেমন পড়বে তাতো সহজেই অনুমেয়। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর প্রভাব কি হবে তাতো সহজেই প্রতীয়মান হবার কথা। এতে সুখকর কিছু তো প্রত্যাশা করা যায় না। নির্বাচনের প্রেক্ষিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের মধ্যে দলাদলি-রেষারেষি-হানাহানি-বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেবে তা কিন্তু বেঠিক নয়। এতে করে আমেরিকার ব্যবসা বাণিজ্য ফুলে ফেপে নাদুস নুদুস হতে পারে কিন্তু এতে করে বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল বা দেশের কোন মঙ্গল হবে না। হতে পারে না। শুধু বাড়বে বিভেদ আর জাতীয় ঐক্যে ধরবে মারাত্মক ফাটল। তাতে করে অনুপ্রবেশের সুযোগ পাবে বাইরের স্বার্থান্বেষীর দল। তাদের জমজমাট হবে অস্ত্রের ব্যবসা।
আমাদের ঘরের বিষয় নির্বাচনে হবে তাদের অনাকাক্সিক্ষত আগমন। আমরা অনেকেই ভাবতে থাকবো-কি দরকার আর দেশের জনগণ, নির্বাচনী সাগর ওরাই পাড় করে দেবে। তাই তো দেখা যায় বিভিন্ন দূতাবাসে বেলা অবেলায় চলে নির্বাচনের প্রচারণা, ক্ষতি নাই হোক না সেথায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নির্লজ্জ বিসর্জন। আমরা ভুলে যাই বিখ্যাত উক্তি বিশ্বের এমন কোন কোন দেশ আছে, যারা একবার কোন দেশের মিত্র হলে সেই দেশের ধ্বংসের জন্য তাদের আর কোন শত্রুর প্রয়োজন হয় না।
যাক গে সে কথা, সর্বমহলেরই বুঝতে হবে ঘরের বিষয়ে পরকে আমন্ত্রণ কোন পরিবার বা দেশের জন্যই শুভবার্তা বয়ে আনে না। আনতে পারে না। শুধুই ঝামেলা বাড়ায়। আর একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে বলাবলি করি- ঘরের কথা পরে জানলো কেমনে। এবার আমাদের নির্বাচনী খবরের কথা একটু বলি। নির্বাচন আসলে প্রার্থীর মনোনয়নপত্র সংগ্রহের কাজ চলবে। দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মাঠে নামবেন এটাই স্বাভাবিক।
২৩.১১.২০২৩ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার এগারো পৃষ্ঠার খবরে একটা অস্বাভাবিক খবরের শিরোনাম দেখা যায়। সেটি হলো- নৌকা চান স্বামী-স্ত্রী, বাবা ছেলে ও দুই ভাই। সম্মানিত পাঠক পাঠিকা মহোদয়। মহোদয়গণের সুবিধার্থে খবরটির একটু অংশ তুলে ধরলাম। যেমন ‘নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী, পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্তত ২০ জন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এদের মধ্যে বর্তমান এমপি অধ্যক্ষ মহিবুর রহমান ও তার সহধর্মীনি অধ্যক্ষ ফাতেমা আক্তার রেখা, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার ও তার ছোট ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত হাবিবুর রহমান, কলাপাড়া পৌরসভার মেয়র বিপুল চন্দ্র হালদার ও তার ছেলে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিকাশ হালদার, যুবলীগ নেতা সৈয়দ আক্তারুজ্জামান কোক্কা ও তার ছেলে টিয়াখালীর সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মশিউর রহমান শিমু মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। এভাবে স্বামী-স্ত্রী, বাবা ছেলে ও দুই আপন ভাই এ আসনে মনোনয়ন চাওয়া নিয়ে মাঠ পর্যায়ে চলছে নানা ধরনের আলোচনা।’
এখন এখানে প্রশ্ন হলো, এই ‘নানা ধরনের আলোচনা’ এর মধ্যে কী কোন ধরনের ভালো আলোচনা রয়েছে? অবশ্যই না। এবং অবশ্যই এখানে নানা ধরনের সমালোচনা, বিতর্ক আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের মন্দ দিকটিই ফুটে উঠেছে। ভোটারদেরকেও হতাশ করেছে এ খবরটি। সর্বোপরি জাতিক জনক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নৌকার কা-ারী তিনি সেই নৌকা আর সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক এই নৌকার জন্য তা কোন সুখবর নয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে এ দেশেরই কেউ কেউ স্লোগান দিতেন ভোটের বাক্সে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন করো। বঙ্গবন্ধুর নৌকা সেদিন তাদের কথায় কান দেননি। সেদিনের ভোটের বাক্সে নৌকা প্রতীকেই তিনি অটল থেকেছেন।
দেশে তখন আয়ূব-ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন চলছিলো। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নৌকা প্রতীক ১৯৭০ এর নির্বাচনে বাঙালির বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। তাই নৌকা অন্যকোন সাধারণ প্রতীকের মতো শুধুই নির্বাচনী কোন প্রতীক নয়। বলা যায়- আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই আজ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তি যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র চলছে। চলছে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র।
৩০.১১.২০২৩ তারিখে রাতে টিভির কোন এক চ্যানেলে টকশো দেখছিলাম। সেখানে জোনায়েদ সাকী নামের একভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলে ফেলেন, ‘সাবেক মুক্তিযোদ্ধা’। এটাও ষড়যন্ত্রেরই অংশ কিন্তু। ওনার বয়স কতো জানি না। উনি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন কিনা তাও জানি না। ওনার অবগতির জন্য বলতে চাই- মুক্তিযোদ্ধারা কোন চাকরীজীবী নন, কোন আমলা নন। মুক্তিযোদ্ধারা বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা কখনও সাবেক হন না। আজীবন মুক্তিযোদ্ধা।
দেশের বিরুদ্ধে, নৌকার বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যখন আজ নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে তখন কোন নির্বাচনী এলাকায় স্বামী-স্ত্রী, বাবা ছেলে ও দুই ভাই এর মধ্যে এমনি ধরনের হেলা-ফেলা-নিঠুর খেলা নৌকার শক্তিকেই দুর্বল করবে। যা জাতির কাছে কখনো কাম্য নয়। তাই আজ মনে মনে ভাবি আর ভাবি- নৌকার যদি ভাষা জ্ঞান থাকতো, সুরের জ্ঞান থাকতো তাহলে গভীর দুঃখ-ভারাক্রান্ত চিত্তে পঞ্চ কবির সেই কবি অতুল প্রসাদ সেনের কথায় গানে-সুরে আপন মনে গেয়ে চলতো- কেন এ নিঠুর খেলা খেলিলে আমার সনে।’
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা , কলামিস্ট।