জাগো বাহে, কোনঠে সবাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৪৭:৩২ অপরাহ্ন
![জাগো বাহে, কোনঠে সবাই জাগো বাহে, কোনঠে সবাই](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2023/12/Untitled-1-copy-7-768x436.jpg)
ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) :
জানুয়ারির ৭ তারিখ আমরা হয়তো জিতে যাব, কিন্তু সেই জয়টাকে অর্থবহ করতে হলে আমাদেরও চাই লাখো-লাখো, কোটি-কোটি মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের সেই মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন আমাদের আজকের তরুণ ভোটাররা, যারা এবারই প্রথমবারের মতো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন। তাদের প্রতি আমাদের প্রচণ্ড ঈর্ষা। কারণ, তারা এমন একটি ব্যালটে সিলটি দেবেন, যে ব্যালটটি কোনো যুুদ্ধাপরাধী কিংবা পাকিস্তানি চরের প্রতীকে কলঙ্কিত নয়। তবে একটা শঙ্কার জায়গাও আছে
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। এবারের নির্বাচনে চ্যালেঞ্জটা একেবারেই ভিন্ন। কে জিতবে আর কে হারবে, এসবকে ছাপিয়ে চ্যালেঞ্জটা এখন ভোটারকে কেন্দ্রমুখী করা। উপড়ে ফেলা ট্রেনের লাইন আর বাসে আগুনের লেলিহান শিখা যেন ভোটারকে কেন্দ্রবিমুখ না করে সেটা যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বয়কট আর বানচালের বেড়াজাল ছিন্ন করে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে হাজির করা। দেশের প্রত্যেক সচেতন মানুষ এখন যার যার জায়গা থেকে এ কাজটাই করায় ব্যস্ত। এরই ধারাবাহিকতায় কজন লিভার বিশেষজ্ঞ গত বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম আমাদের এ জায়গাটায় করণীয়টা কি?
এমনিতেই বদনাম আছে আমরা চিকিৎসকরা আশপাশটা নিয়ে খুব বেশি চর্চা ও চিন্তা করি না।
বিষয়টা আংশিক হলেও পুরোপুরি যে সঠিক নয়, এ পেশায় জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে এই জিনিসটা এখন ভালোই জানি। নির্বাচনের সময় আমাদের নির্বাচনী ব্যস্ততার বড় একটা জায়গাজুড়ে থাকে বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থীদের পক্ষে মেডিক্যাল ক্যাম্প আয়োজন করা। এটি এক ধরনের পেশাগত দায়িত্ব বলা চলে। আমরা যারা লিভারের ডাক্তারি করি, বিষয়টা আমাদের জন্যও কমবেশি তেমনই। এবারের নির্বাচনেও তার ব্যত্যয় ঘটছে না। তবে কজন লিভার বিশেষজ্ঞ মাসখানেক আগেই ঠিক করেছিলাম আমরা এবার ব্যতিক্রমী কিছু একটা করব।
আমরা এমন কজন লিভার বিশেষজ্ঞ, যারা প্রত্যেকে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনকালে বিভিন্ন সময় দেশের ভিন্ন ভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। এমন ভাবনা থেকেই উদ্যোগটার জন্ম। আমাদের মধ্যে আছেন ডা. ডিউ। এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। এক সময় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি।
ছাত্র সংসদের কোনো পদে নির্বাচনের জন্য মনোনীত হওয়ার শিকেটা কপালে কখনোই ছিড়েনি। তবে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকরী সদস্যের পদটিকেই এখনো আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলেই গণ্য করি। আমাদের মধ্যে আর যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা কমবেশি আমাদেরই মতো। ডা. ডিউর পেশাগত পরিচয়ের পাশাপাশি নতুন আরেকটি পরিচয় তিনি হালজমানার একজন প্রতিশ্রুতিশীল গীতিকারও বটে। এহেন ডা. ডিউ লিখলেন, ‘ভোট দেব সবাই, বারবার দরকার শেখ হাসিনার সরকার’।
এর পরের পথ চলাটা নতুন হলেও কাজটায় আমরা শেষমেশ ভালোভাবেই উতরে গিয়েছি বলেই মনে হয়। সবাই মিলে দল বেঁধে বন্ধুপ্রতিম নির্মাতা সাইফ ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে যে মিউজিক ভিডিওটা দাঁড় করানো হলো, দেখেশুনে মনে হলো জিনিসটা খুব একটা খারাপ দাঁড়ায়নি। বিশেষ করে মিউজিক ভিডিওটায় মডেল হিসেবে নিজেদের দেখতে ভালোই লাগছিল।
গানটির আনুষ্ঠানিক সম্প্রচার শুরু হলো নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হওয়ার পরপরই। জাতীয় প্রেসক্লাবের কানায়-কানায় পূর্ণ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা মিলনায়তনে আলোচক হিসেবে সেদিন উপস্থিত ছিলেন এমনকিছু মানুষ, যারা প্রত্যেকে যার যার ক্ষেত্রে নক্ষত্র তো বটেই, জাতির জন্যও তারা একেকজন অনন্য সম্পদ। সঙ্গত কারণেই তাদের আলোচনা ছিল সেরকমই ভারি। তাদেরই একজন শ্যামল দত্ত। জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক একাধারে দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক আর জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। শ্যামল দা তার নাতিদীর্ঘ আলোচনায় আগামী নির্বাচনকে তুলনা করলেন আমাদের তৃতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। আসলেই তাই।
একাত্তরে আমাদের প্রথম মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম পাকিস্তানি হানাদারদের হারিয়ে দিয়ে। আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ পঁচাত্তরের পর। সময় লাগলেও সেখানটাতেও আমরাই বিজয়ী হয়েছি। কারণ, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর পাকিস্তানের আজ্ঞাবহ একের পর এক শাসকদের বাংলাদেশের শত মিটার স্প্রিন্টের গতিতে যে ক্রমাগত পেছন দিকে ছুটে চলা, তাতে অবশেষে যতি টেনেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০০৯-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসরদের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে। এখন আমরা আরেকটি নির্বাচনের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে। এটি এমন একটি নির্বাচনে রূপ নিতে যাচ্ছে, যেখানে জাতীয় সংসদে যারা নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তারা যেমন স্বাধীনতার স্বপক্ষীয় হবেন, তেমনি যারা এই প্রক্রিয়ায় পরাজিত হবেন তাদের আদর্শিক জায়গাটাও অভিন্ন। ৭৩-এর পর এই প্রথম আমরা আবারও এমন একটি স্বপ্নের জাতীয় সংসদ পেতে যাচ্ছি।
সঙ্গত কারণেই নির্বাচনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেশী-বিদেশী চক্রান্তের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। লক্ষণীয়, একাত্তরে আমাদের প্রথম মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশী বন্ধুরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, আজও তাদের সেই অবস্থান অপরিবর্তিতই আছে। সে সময় যারা আমাদের লাল-সবুজের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাদের কেউ কেউ পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এখন নৌকায় সওয়ার হলেও মোটা দাগে সেদিনের প্রতিপক্ষরা এখনো তাদের সেই অবস্থানটাই ধরে রেখেছেন। কাজেই আগামী মুক্তিযুদ্ধটা আমাদের জন্য মোটেও সহজ হতে যাচ্ছে না। জানুয়ারির ৭ তারিখ আমরা হয়তো জিতে যাব, কিন্তু সেই জয়টাকে অর্থবহ করতে হলে আমাদেরও চাই লাখো-লাখো, কোটি-কোটি মুক্তিযোদ্ধা।
আমাদের সেই মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন আমাদের আজকের তরুণ ভোটাররা, যারা এবারই প্রথমবারের মতো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন। তাদের প্রতি আমাদের প্রচণ্ড ঈর্ষা। কারণ, তারা এমন একটি ব্যালটে সিলটি দেবেন, যে ব্যালটটি কোনো যুুদ্ধাপরাধী কিংবা পাকিস্তানি চরের প্রতীকে কলঙ্কিত নয়। তবে একটা শঙ্কার জায়গাও আছে। জয়টাকে অবধারিত ধরে নিয়ে তারা যদি ৭ তারিখ সারাদিন ভোটকেন্দ্রে ভিড় না জমান, তবে বিজয়টাই নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। কারণ, বাঙালির এই চূড়ান্ত বিজয়োল্লাসকে কান্নায় পরিণত করায় আগ্রহীর সংখ্যাও তো দেশে-বিদেশে অনেক।
তারা তো এরই মধ্যে মরণ কামড় বসাতে শুরু করেছে। শোনা যায়, শীতের কুয়াশায় মোড়া ঢাকার রাজপথে তাদের স্বপ্ন এখন আরবের বসন্তকে আমদানি করা। বাসে আগুন দিয়ে কাজ হয়নি। কাজ হয়নি হাজারো হুমকি-ধমকিতেও। এখন চলছে ট্রেনের লাইন উপড়ে ফেলে সরকারকে উল্টে দেওয়ার পাঁয়তারা। কাজ হবে না এতেও। প্রধানমন্ত্রী তো সিলেটে লাখো মানুষের জোয়ারে স্পষ্টই বলেছেন, দু-একটা ট্রেনে-গাড়িতে আগুন দিয়ে সরকার উল্টোনো যায় না। ওরাও এটা ভালোই জানে।
তাই মুখে হয়তো অসহযোগের প্রলাপ বকছে, কিন্তু নিশ্চিত করেই তাদের কুটিল মনোজগতে চলছে অনেক জটিল চক্রান্তের বুনন। এই অপশক্তিকে চূড়ান্তভাবে হারিয়ে দিতে আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের ভোটকেন্দ্রে আসতেই হবে। আমরা গান লিখব, গাইব, করব আরও কত কিছু, কিন্তু এই তরুণরা যদি ৭ তারিখে না আসে, তবে অন্যরা জিতে যেতে পারে। গলা ছেড়ে তাই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবাই ?’
লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।