শিয়াবে আবু তালিবে নবীজির কষ্টের দিনগুলি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ৬:৪৭:৩৪ অপরাহ্ন
রেজওয়ান আহমেদ :
শিয়াবে আবু তালিব নবীজী (স.) এর জন্মস্থান ও জাবালে আবু কুবায়সের মধ্যখানে পাহাড়ের নিচু অংশে অবস্থিত।
শিয়াবে আবু তালিবের ইতিহাস : একদিন আবু জাহেল আল্লাহর রাসূলের (স.) সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করে। সেই সময় হামজা (রা.) ছিলেন শিকারে। শিকার থেকে ফিরে এসে তিনি এই ঘটনা শুনেন। তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারলেন না। শিকারের তীর ধনুক নিয়েই চলে গেলেন কা’বার দিকে। আবু জাহেলকে পেয়ে তীব্র রাগ করলেন। কঠিন ভাষায় বকলেন।
তারপর হযরত হামজা (রা.) নিজেই ঘোষণা করলেন, আজ থেকে আমিও ইসলাম গ্রহণ করলাম! এর পর আবু জাহেল নবীজীকে হত্যা করার জন্য হযরত ওমর (রা.)-কে পাঠালো তিনি হত্যা করতে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ কর ফেললেন। হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানরা কা’বার চত্বরে প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করতে শুরু করেন।
এতে আবু জাহেলসহ কুরাইশদের রাগ চরমে উঠে। তারা বলতে লাগল, বানু হাশিমের সহযোগিতাই মুহাম্মাদ (স.) এর শক্তি হচ্ছে। তাই বানু হাশিমের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা সকলে মিলে বানু হাশিমকে জানিয়ে দিল যে, আমরা মুহাম্মদ (স.) কে হত্যা করব। তোমরা মুহাম্মাদ (স.)কে আমদের হাতে তুলে দাও। যদি না দাও, তাহলে আমরা তোমাদেরকে বয়কট করব।
নবীজীর চাচা আবু তালিব জানিয়ে দিলেন আমি মরে গেলেও আমার ভাতিজাকে তোমাদের হাতে তুলে দেবনা। আবু তালিব তাঁর সকল আত্মীয়স্বজন ও বনি হাশিম বংশের প্রতি আহ্বান জানান যে তোমরা মুহাম্মদ (স.)কে সাহায্য করো।
এই ঘোষণা দিয়ে আবু তালিব বানু হাশিমের লোকদেরকে নিয়ে ‘শিয়াবে আবু তালিবে’ অবস্থান গ্রহণ করেন। একমাত্র আবু লাহাব ছাড়া বানু হাশিমের মুসলিম-অমুসলিম সবাই শিয়াবে আবি তালিবে মুহাম্মাদ (স.)’র সঙ্গী হন।
কুরাইশরা চিন্তা করল যে, এখন মুহাম্মদ (স.)-কে হত্যা করা যাবে না। এখন হত্যা করতে গেলে মক্কায় ভয়াবহ রক্তপাত হবে। তাই তারা নির্যাতনের একটি নতুন পথ আবিষ্কার করল। কুরাইশ নেতৃবর্গের একটি উচ্চ পর্যায়ের পরিষদবর্গ এক চুক্তিনামা স্বাক্ষর করে বায়তুল্লাহ শরীফের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখেল যে, মুহাম্মদ (স.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে সাথে অর্থনৈতিক লেনদেন করা যাবেনা। তাদের কারো সাথে ক্রয়বিক্রয় করা যাবেনা। তাদের সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখা যাবেনা। তাদের কারো সাথে মেয়ে বিয়ে দেওয়া যাবেনা। তাদের কোনো মেয়েকে বিয়ে করাও যাবেনা- ইত্যাদি।
তখন আবু তালিব ছিলেন আরবের অবিসংবাদিত নেতা, খানায়ে কা’বার মুতাওয়াল্লী। সবকিছ ছেড়ে তিনি মায়ার ভাতিজা রাসূল (স.) এর সিকিউরিটি হয়ে শিয়াবে আবি তালিবে অবস্থান করলেন। নিজেকে বিলীন করে দিলেন নবীজীর তরে। আবু তালেব সব সময় রাসুল (স.)-কে নিয়ে চিন্তায় থাকতেন। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবু তালেব তাঁর প্রিয় ভাতিজা মুহাম্মদ (স.)’র ঘুমানোর স্থান পরিবর্তন করে দিতেন। কখনো নবীজীর বিছানায় তিনি নিজে বা নিজের পুত্র, ভাই বা অন্য কাউকে রাখতেন। যাতে প্রিয় ভাতিজা আল্লাহর রাসুল (স.)-কে যেন রাতের গভীরে কেউ হত্যা করতে না পারে। আবু তালিব রাতে ঘুমাতেননা খুবই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রাত কাটাতেন। এ অবরুদ্ধ জীবনে পরিস্থিতি এতো গুরুতর হয়ে উঠল যে, তাদের খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। নবীজি (সা.) ও তাঁর সাথীরা গাছের লতা পাতা ও চামড়া খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। এসব খাবার খাওয়ায় তাদের পায়খানা হতো ছাগলের বড়ির মতো।
ক্ষুধার কষ্ট এত মারাত্মক ছিল যে, ক্ষুধার্ত নারী ও শিশুর কান্না শিয়াবে আবু তালেব ঘাঁটির বাইরে থেকেও শোনা যেত। বাহির দেশে থেকে মক্কায় আসা জিনিস কেনার চেষ্টা করেও অনেক সময় তাঁরা সক্ষম হতেন না। কারণ কুরাইশরা সেসব জিনিসের দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিত। তাঁদের কাছে কোনো খাদ্য পৌঁছানো যেতনা। যা কিছু পৌঁছত সেসব গোপনীয়ভাবেই পৌঁছাত। নিষিদ্ধ মাসসমূহ ছাড়া প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য তাঁরা ঘাঁটির বাইরে বের হতেন না। হাকিম ইবনে হাজাম ছিলেন খাদিজা (রা.)-এর ভতিজা। মাঝে মাঝে তিনি ফুফুর জন্য গম পাঠাতেন। এটা ছিল মহানবী (স.)-এর নবুওয়তের সপ্তম বছরের ঘটনা। তারা শিয়াবে আবি তালিবে ১ দিন নয়, ১ সাপ্তাহ নয়, ১ মাস নয়, ৩টি বছর অবরুদ্ধ জীবনযাপন করেন।
বনু আমির গোত্রের হিশাম বিন আমর। রাতের অন্ধকারে গোপনে গোপনে ‘শিয়াবে আবু তলিব’ গিরি সংকটের ভিতরে খাদ্য প্রেরণ করে বনু হাশিমের লোকজনদের সাহায্য করতেন।
একদিন যুহায়েরের মাতা আতেকা, যিনি আব্দুল মুত্তালিবের মেয়ে। তিনি যুহাইরকে বললেন, যুহাইর! বর্তমানে তোমার মামার বংশের যে অবস্থা চলছে, তা তুমি ভালভাবেই জানো। তুমি এটা কিভাবে বরদাস্ত করছো। মায়ের কথা শুনে যুহাইর বললেন, এ ব্যাপারে আমি একা কী করব! যদি আমার সঙ্গে আর কেউ থাকত তাহলে অবশ্যই আমি এটা ছিঁড়ে ফেলার ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। হিশাম বললেন, আমি আছি তোমার সঙ্গে।
যুহায়ের এবং হিশাম দু’জনে মুতইম ইবনু আদি, আদি ইবনু কাইস, যামআহ ইবনুল আসওয়াদ, আবুল বুখতারীকে নিয়ে হাজুনের নিকট একত্রিত হয়ে এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন যে, কুরাইশগণের অঙ্গীকারনামা অবশ্যই ছিঁড়ে ফেলতে হবে। যুহাইর বললেন, এ ব্যাপারে আমিই সর্বপ্রথম মুখ খুলব। কথামতো পরদিন যুহাইর নতুন কাপড় পড়ে বায়তুল্লায় উপস্থিত হলেন। প্রথমে তিনি বায়তুল্লাহ ৭ বার প্রদক্ষিণ করে নিলেন।
তারপর সমবেত জনগণকে সম্বোধন করে বললেন, হে মক্কাবাসীগণ! আমরা তৃপ্তি সহকারে উদর পূর্ণ করে খাওয়া-দাওয়া করব, উত্তম পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করব। আর বনু হাশিম ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা আমি মেনে নিতে পারবনা।
আল্লাহর শপথ! আমি ততক্ষণ পর্যন্ত বসে থাকতে পারব না, যতক্ষণ ঐ অন্যায় ও উৎপীড়নমূলক অঙ্গীকারনামা ছিঁড়ে ফেলা না হচ্ছে। আবু জাহল মাসজিদুল হারামের নিকটেই ছিল। সে বললো, তুমি ভুল বলছ। আল্লাহর শপথ! তা ছিঁড়ে ফেলা হবে না।
সাথে সাথে যাময়া বিন আসওয়াদ বলে উঠল, ‘আল্লাহর কসম! আবু জাহেল, তুমি অধিক ভুল বলছ। কিসের অঙ্গীকারপত্র! ওটা লিখার ব্যাপারে আমাদের কোন সম্মতি ছিল না। তাদের সমর্থনে হিশাম বিন আমরও অনুরূপ কথাবার্তা বললেন।
আবু জাহেলর সাথে তাদের তর্কবিতর্ক চলছে…। এদিকে আবু ত্বালিবও পবিত্র হারামের এক প্রান্তে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন আমার আগমনের কারণ হচ্ছে, আমার ভাতিজা মুহাম্মদ (স.) আমাকে পাঠিয়েছেন, আপনাদের এ কথা জানিয়ে দেওয়ার জন্য যে, আল্লাহ তা‘আলা এক প্রকার কীট বা পোকা দিয়ে তোমাদের অঙ্গীকারনামার সমস্ত লিখা নষ্ট করে দিয়েছেন। পোকা সমস্ত লেখা খেয়ে ফেলেছে। শুধুমাত্র আল্লাহর নাম অবশিষ্ট রয়েছে।
আবু তালিব কুরাইশগণকে লক্ষ করে বললেন, যদি আমার ভাতিজা মুহাম্মদ (স.) এর কথা সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে এই অঙ্গীকারনামা বাতিল করে আমাদের প্রতি যে অন্যায় অত্যাচার করে আসছেন, তা থেকে বিরত হতে হবে। আর যদি তাঁর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে তাঁর ও আপনাদের মধ্যখান থেকে আমি সরে দাঁড়াব। আপনাদের যা ইচ্ছে হয় তাই করবেন। আবু তালিবের কথায় কুরাইশগণ বললেন, আপনি ইনসাফের কথাই বলছেন।
মুত্ব’ঈম বিন আদী বায়তুল্লাহর দেয়াল থেকে অঙ্গীকারনামা ছিঁড়ে নিয়ে আসলেন। তারপর সেটা হাতে নিয়ে সত্যি সত্যিই দেখা গেল যে, এক প্রকার কীট লেখাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছে। শুধু মাত্র ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ কথাটি অবশিষ্ট রয়েছে এবং যেখানে যেখানে আল্লাহর নাম লেখা ছিল শুধু সেই লেখা গুলোই অবশিষ্ট রয়েছে!
তারপর অঙ্গীকারনামা ছিঁড়ে ফেলা হল এবং এর ফলে ৩ বছর পর বয়কটের অবসান ঘটল। আবু তালিব ও হযরত খাদিজা (রা.) অবরোধ চলাকালীন সময়ে শিয়াবে আবি তালিবে তাঁদের সকল সম্পদ ব্যয় করে ফেলেছিলেন। শিয়াবে আবু তালিবে কাফেরদের ৩ বছরের নির্যাতনে হযরত খাদিজা (রা.) ও আবু তালিব অনেকটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন। আবু তালিব বুড়ো হয়ে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গিয়ে ছিল। বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েকদিন পরই আবু তালিব ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিলো ৮৭ বছর।
আবু তালিব তাঁর ৮৭ বছরের জীবনের এক মুহূর্তের জন্য তিনি মুর্তি পূজায় অংশগ্রহণ করেন নি। আবু তালিব ছিলেন খানায়ে কা’বার মুতাওয়াল্লী। এ জন্যই মক্কাবাসীদের নিকট তিনি ছিলেন সবচাইতে সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। আবু তালিব ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর ধর্মের অনুসারী। তিনি মুর্তি পুজা বা অংশীবাদে কখনও বিশ্বাস করতেন না। আবু তালিবের সন্তান হযরত আলী (বা.) হযরত জাফর (রা.) হযরত আকিল (রা.)
জুমানাহ এবং ফাখতাহ (উম্মে হানী)। আবু তালিবের এর পুত্র হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব (রা.) মু’তার যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি হিসাবে অসীম বীরত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শাহাদাতবরণ করেন।
তাঁর শাহাদাতের পর মহানবী (সা.) দীর্ঘদিন ধরে শোকাভিভূত ও বিমর্ষ ছিলেন। আর তাঁর দু’চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। অবশেষে হযরত জিবরাইল (আ.) এসে মহানবী (সা.) কে সুসংবাদ দান করেন যে, আল্লাহপাক জাফরকে তাঁর দু’টো হাতের পরিবর্তে নতুন দু’টি রক্তরাঙ্গা হাত দান করেছেন এবং তিনি জান্নাতে ফেরেশতাদের সাথে উড়ে বেড়াচ্ছেন। এজন্য তাঁকে বলা হয় ‘জাফর-এ-তৈয়ার’ বা দু’পাখার অধিকারী জাফর।
নবীজী (সা.) এর বয়স যখন আট বছর, তখন তাঁর অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আব্দুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করেন। দাদার মৃত্যুর পর তাঁর চাচা আবু তালিব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আবু তালিবের মৃত্যুর পর নবীজী তাঁর জন্য দোয়া করেছেন। আবু তালিবের মৃত্যুর কিছুদিন পরই রাসূল (স.) এর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা (রা.) ইন্তিকাল করেন। আবু তালিব ও খাদিজার (রা) ইন্তিকালে মুশরিকরা উল্লাসিত হয়। এরপর তারা মুহাম্মাদ (স.) ও তাঁর সাথীদের উপর পুনরায় চরম অত্যাচার শুরু করে।
এরপর রাসূল (স.) সিদ্ধান্ত নেন, তায়েফ গিয়ে ইসলাম প্রচার করবেন। তাই তিনি তায়েফ চলে যান। তায়েফের ইতিহাস আরো বেদনার!
লেখক : মুয়াল্লিম, লতিফ ট্রাভেলস মক্কা মুকাররমা।