হবিগঞ্জে শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষিত বর্জ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মার্চ ২০২৪, ৩:৫৯:১২ অপরাহ্ন

হবিগঞ্জ থেকে মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল : হবিগঞ্জ জেলায় গত দুই দশকে বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে উঠা দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্যে বিভিন্ন স্থানে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থাপনা (ইটিপি) নিশ্চিত না করেই উৎপাদনে চলে যাওয়ায় দিন দিন এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে।
বর্তমানে কোন কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে অপরিশোধিত, বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত বর্জ্য খাল-নদী-হাওরে ছেড়ে দেয়ায় মাধবপুর, হবিগঞ্জ সদর, বাহুবল, শায়েস্তাগঞ্জ ও লাখাই উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার জীববৈচিত্র, ফসল ও মৎস্য সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। সেচকার্য হচ্ছে বিঘিœত। বিষাক্ত বর্জ্যওে দূষিত বাতাসে নর-নারী ও শিশুরা শ্বাসকষ্ট, চর্ম রোগসহ বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। পরিবেশ বিপর্যয়ের এই আশংকা সত্বেও নির্বিকার রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
গত ২৩ মার্চ শিল্পায়নে পানি দূষণের ব্যাপারে হবিগঞ্জের বিভিন্ন শিল্প এলাকা পরিদর্শন করেন খোয়াই রিভার ওয়াটার কিপার, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর কর্মকর্তারা। তারা মাধবপুর উপজেলার রতনপুর-ছাতিয়াইন সড়কে গুপলপুরের নিকটস্থ একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে ছাতিয়াইন খালে ছেড়ে দেয়া অপরিশোধিত বিষাক্ত দুর্গন্ধযুক্ত কালো রংয়ের বর্জ্য দেখতে পান। এসময় খালের পানির উপরে বর্জ্যরে গাঢ় স্তরের উপরে বুদ বুদ উঠতে দেখেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় সড়কের উপর কালো পিচ ঢালা হয়েছে।
উপস্থিত এলাকাবাসী জানান, এই খালের বর্জ্য খড়কি গাঙ হয়ে এক অংশ তিতাস নদীতে এবং অপর অংশ খাষ্টি নদী ও মেঘনা নদীতে ছড়িয়ে পড়ছে। একসময় এই খালটি স্বাভাবিক নৌ চলাচল ছাড়াও এলাকার কৃষকদের জমিতে সেচ কার্যে ব্যবহৃত করা হত। যা বর্তমানে অকল্পনীয়।
এলাকাবাসী আরো অভিযোগ করেন, খালের নিকটস্থ গ্লোরি এগ্রো প্রোডাক্ট নামক একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিনিয়ত তরল বর্জ্য খালে ফেলে দেয়া হচ্ছে। বর্জ্যরে দুর্গন্ধে রাস্তায় চলাফেরাসহ বাড়ী ঘরে বসবাস করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। পরে পরিদর্শক দল রতনপুর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরবর্তী পিয়াইম গ্রামের ব্রীজের নিচ দিয়ে প্রবাহিত অপর একটি খালে বর্জ্যবাহিত একই রংয়ের কালো পানি দেখতে পান। সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরবর্তী উচাইল ব্রীজের নিচ দিয়ে প্রবাহিত সুতাং নদীতেও কালো পানি দেখতে পান। শৈলজুরা খাল দিয়ে দূষিত শিল্প বর্জ্য সুতাং নদীতে ফেলে দেয়ায় এই নদীটি বর্তমানে দেশের মারাত্মক দূষিত ৩টি নদীর মধ্যে ১টি হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। এই নদীর দূষিত পানি বলভদ্র ও মেঘনা নদীতে ছড়িয়ে পড়ছে।
পরিবেশ কর্মী আব্দুল কাইয়ুম জানান, ছাতিয়াইন খাল ছাড়াও বর্জ্যে দূষিত ফকিরা খাল, রাজখাল, খড়কি গাঙ ও সুতাং নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ফজলুর রহমান জানান, শিল্পবর্জ্যরে দুর্গন্ধে এলাকার সাধারণ মানুষ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আশিক মিয়া জানান, কোম্পানীকে দূষিত বর্জ্য খালে না ফেলার জন্য অনুরোধ করা সত্বেও তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
আজহারুল হোসেন বাবুল জানান, শিল্পবর্জ্যরে কারণে আমাদের খাল নদী জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গ্লোরি এগ্রো প্রোডাক্ট লিমিটেড এর পরিচালক সারোয়ার আহমেদ জানান, খালের পানি নষ্টের জন্য তারা দায়ী নন। একটি গোষ্ঠী শত্রুতাবশতঃ কোম্পানীর পেছনে লেগেছে। খালের স্বাভাবিক পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় জলাবদ্ধ হয়ে পানিতে দুর্গন্ধ হচ্ছে। তিনি জানান, পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীরা আমাদেরকে দোষ দিচ্ছে অথচ কারখানার ইটিপি সবসময় চালু আছে। যারা কোম্পানীর বিরুদ্ধে লেগেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খোয়াই রিভার ওয়াটার কিপার তোফাজ্জল সোহেল জানান, দেশের প্রচলিত সকল আইন অমান্য করে কলকারখানাগুলো অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য নিক্ষেপ করে জেলার নদী-খাল-হাওর দূষিত করছে।
জেলা বাপা সভাপতি অধ্যক্ষ ইকরামুল ওয়াদুদ জানান, শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত বিষাক্ত তরল বর্জ্যে পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। জনদুর্ভোগ লাঘবে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফয়সল জানান, গ্লোরি এগ্রো প্রোডাক্টের বিরুদ্ধে দেয়া অভিযোগের তদন্ত রিপোর্ট পেয়েছি। ইতিমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরকে এ ব্যাপারে অবগত করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হবিগঞ্জ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আক্তারুজ্জামান জানান, গ্লোরির বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত করেছি। পরীক্ষায় পানি দূষণের আলামত পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত রিপোর্ট সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।