ফলোআপ: সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য
এক বছরেও অভিযোগপত্র দিতে পারেনি সিআইডি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মে ২০২৪, ৬:০২:৪৮ অপরাহ্ন
নূর আহমদ :
সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে জনবল নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত প্রায় এক বছরেও শেষ করতে পারেনি ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। যদিও সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা চলতি মাসেই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র দাবি করেছে, একটি শক্তিশালী চক্র চাকুরি প্রত্যাশী ৮ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র প্রদানের চাপ সৃষ্টি করছে। দুদকে মামলা স্থানান্তরের মাধ্যমে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করার চেষ্টায় লিপ্ত ওই চক্র।
২০২৩ সালের ২২ মার্চ ‘লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা না দিয়েও নিয়োগ পেলেন ৯ পরিবার কল্যাণ সহকারী’ শিরোনামে-দৈনিক সিলেটের ডাক-এ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটি সিলেট তথা পুরো স্বাস্থ্য বিভাগে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করে। এরপর ডিপার্টমেন্টাল (বিভাগীয়) তদন্ত করে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে চাকুরিরত ৮ জনকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে থানায় মামলা করেছিলো। আর জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিন এর বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ধরা পড়ায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ চলমান রয়েছে। এর অংশ হিসেবে তাকে বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরই মধ্যে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর হলে প্রথমে বেশ গতি ছিল তদন্ত কার্যক্রমে। এসময় জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিনের অন্যতম সহযোগী বরুণ ছত্রীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। বরুণ ছত্রী নিজে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তিনি জবানবন্দিতে তার নির্দেশদাতা ও মূলহোতা হিসেবে ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিনের কথা উল্লেখ করেন। বর্তমানে বরুণ ছত্রী জামিনে রয়েছেন।
অন্যদিকে, রহস্যজনক কারণে শুরুতেই মামলার আসামী করা হয়নি সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িতদের। বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে জড়িতদের নাম আসলে পরে পুলিশ তাদের অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বললেও মূলত আইনের ফাঁক-ফোকর খুঁজছিলো চক্রটি। অভিযোগ রয়েছে, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে যাচ্ছে ওই চক্র।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গণমাধ্যমে দুর্নীতি উঠে আসার পর একটি শক্তিশালী বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে পরিবার ও পরিকল্পনা অধিদপ্তর। প্রশাসনিক ইউনিটের সহকারী পরিচালক মো: আব্দুল মান্নান, অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল বাতেন ও ঢাকা বিভাগের পরিচালক যুগ্ম সচিব মো: মাহবুব আলম এর সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি দীর্ঘ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার স্মারক নং ৫৯.১১.০০০০.১৫২.১১.০০৩.২৩-১৫৭। ওই প্রতিবেদনে পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়, ‘ তদন্ত কমিটির নিকট দাখিলকৃত সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ও বক্তব্য বিশ্লেষণে ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিন, উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), পরিবার পরিকল্পনা, সিলেট এর বিরুদ্ধে এখতিয়ার বহির্ভূত ৩ বেআইনি এবং দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত। তাঁর এহেন এখতিয়ার বহির্ভূত ও বেআইনি এবং দুর্নীতিমূলক কার্যক্রমের সাথে (১) মোঃ মনসুর আহমদ, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, কোম্পানীগঞ্জ ও সংযুক্ত আঞ্চলিক পণ্যাগার, চৌহাট্টা, সিলেট, (২) মহিতোষ মজুমদার, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, ওসমানীনগর, সিলেট, (৩) মানদা রঞ্জন তালুকদার, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত), উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট এবং (৪) চন্দন রায়, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, সদর, সিলেট এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ও অপরাধের প্রমাণ রয়েছে।’ তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয় ওই প্রতিবেদনে। এছাড়া, প্রতিবেদনে আরো কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তাদের সতর্ক করা হয় এবং গাফিলতির তথ্য তুলে ধরা হয়। মামলায় অভিযুক্ত ৮ চাকুরি প্রত্যাশীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।
অপরদিকে, বিভাগীয় তদন্তে জড়িতদের নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করলেও সূত্র জানিয়েছে সিআইডি তা আমলে নিচ্ছে না। সূত্র জানিয়েছে, চাকুরি প্রত্যাশী ৮ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র প্রদানের জন্য উপর মহল থেকে চাপ রয়েছে। অন্যদিকে, এয়ারপোর্ট থানায় দায়েরকৃত মামলাটিতে দুদক আইনের ধারা না থাকা সত্ত্বেও ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিনসহ জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করবে জানিয়ে দায়সারাভাবে মামলার অভিযোগপত্র দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ওই সূত্র।
এ ব্যাপারে সিআইডির সাব ইন্সপেক্টর রিপন কুমার দে বলেন, বরুণ ছত্রী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তার সাথে সম্পৃক্তদের নামও বলেছে। চলতি সপ্তাহেই প্রতিবেদন দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। তিনি বলেন, শুধুমাত্র এজাহারভুক্ত চাকুরি প্রত্যাশী ৮ আসামী অভিযুক্ত হবেন না আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়া বরুণ ছত্রী ও ডাঃ লুৎফুন নাহার জেসমিনসহ অপর জড়িতরা অভিযুুক্ত হবেন কিনা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানান তিনি। তিনি জানান, মামলাটি ভাগ হয়ে যাওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
মামলার বাদী বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, সিলেট এর সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবুল মনসুর আসজাদ বলেন, আমি যতটুকু জানি মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে। গত মাস দুয়েক আগে দুদক থেকে এক তদন্তকারী কর্মকর্তা ফোনে কিছু তথ্য নিয়েছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু তার জানা নেই বলে জানান তিনি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সিলেট বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) তপন কুমার ঘোষ বলেন, জেনেছি মামলাটি সিআইডির পাশাপাশি দুদক তদন্ত করছে। এর বাইরে আর কিছু জানেন না বলে জানান এ কর্মকর্তা।