সিলেট বোর্ডের খারাপ ফলাফলের নেপথ্যে বিজ্ঞান শিক্ষায় অনাগ্রহ, বিদেশমুখী প্রবণতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ মে ২০২৪, ২:৩৫:৪১ অপরাহ্ন
আনাস হাবিব কলিন্স :
মানসম্মত শিক্ষকের অভাব, বিজ্ঞান শিক্ষায় অনাগ্রহ, অভিভাবকদের অসচেতনতা সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতা-এসএসসিতে সিলেট বোর্ডের খারাপ ফলাফলের পেছনে প্রভাব ফেলছে। এ অঞ্চলের শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং বোর্ড সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত রোববার প্রকাশিত এসএসসি’র ফলাফলে দেখা গেছে, গত দুই বারের ধারাবাহিকতায় সিলেট বোর্ড এবারও সর্বনিম্ন ফলাফল করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বিজ্ঞান শিক্ষায় পশ্চাদপদতা, উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্দেশনায় দুর্বলতা, প্রশিক্ষণবিহীন পরীক্ষক দ্বারা উত্তরপত্র মূল্যায়ন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাথে শিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়হীনতা, নিবন্ধনধারী শিক্ষকের অভাব, শিক্ষার্থীদের গণিত ও ইংরেজি ভীতি-কে ফলাফল বিপর্যয়কেও দায়ী করেছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষক দেশের বিভিন্ন জেলার অধিবাসী। তারা ওই এলাকার বাসিন্দা না হওয়ায় স্থানীয় শিক্ষার্থীদের পাঠদানে তারা সংবেদনশীল নন।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক মো. কবির আহমদ মনে করেন, এসএসসিতে সিলেট বোর্ডে ভাল ফলাফলের অন্যতম অন্তরায় বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার পরিবর্তে মানবিক বিভাগে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি। পাশাপাশি রয়েছে মান সম্মত শিক্ষকের অভাব। নিবন্ধনধারী অনেক শিক্ষক প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না বলেও মন্তব্য এ শিক্ষাবিদের। সংশ্লিষ্ট মহলকে এ বিষয়টির ওপর আরো গুরুত্ব দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বোর্ডে তাঁর দায়িত্বপালনকালীন বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভলপমেন্ট ইউনিট (বেডো’র) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান থাকলেও সেটি এখন বন্ধ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মাউশি সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক প্রফেসর আব্দুল মান্নান সিলেটে বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার পরিধি আরো বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বোর্ডের যে কোন উদ্যোগে মাউসি’র সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। সিলেটে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে তারা কাজ করছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত রোববার এসএসসির ফলাফল ঘোষণা অনুষ্ঠানে সিলেট বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক অরুণ চন্দ্র পাল পাশের হার কমার জন্য মানসম্মত শিক্ষকের অভাবকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, সিলেট বিভাগের বিশাল এলাকাজুড়ে দুর্গম হাওর এলাকা। এসব এলাকায় ভালো মানের শিক্ষক পাওয়া যায় না। এর প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলে। এছাড়া, মানবিক বিভাগে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির কারণেও পাশের হার কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থী বাড়লে ফলাফলও ভালো হয়। আমাদের বোর্ডে মানবিক বিভাগে যেভাবে শিক্ষার্থী বেড়েছে; সেভাবে আশানুরূপ ফলাফল আসেনি। মানবিকে এবার পাসের হার ৬৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষায় জোর দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সুশাসনের জন্য সুনাগরিক (সুজন) সিলেট চ্যাপ্টারের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ফি বছর সিলেট বোর্ডে এসএসসির ফলাফল বিপর্যয় সিলেটবাসীর জন্য ‘অশনি সংকেত’। এ অবস্থা নিরসনে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি বলে মনে করেন তিনি।
মফস্বলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খারাপ ফল করছে
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ছনবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ১৪৫ জন। এর মধ্যে পাশ করেছে ৮৬ জন। এ বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়নি। বিজ্ঞান বিভাগের ১২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কৃতকার্য হয়েছে ৭ জন। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রকিব স্বীকার করেছেন, পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে তাদের পাঠদানে বিঘ্ন ঘটছে। এবারের এসএসসির ফলাফলে এর প্রভাব পড়েছে।
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে পলাশ উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের ২২০ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১৩২ জন। পাশের হার ৪০ শতাংশ। এ বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়নি। এলাকাবাসী মনে করেন, মানসম্মত শিক্ষকের অভাবে এসএসসিতে ফল বিপর্যয় ঘটেছে। তবে, প্রধান শিক্ষক ইকবাল হোসেন অভিভাবকদের অসচেতনতাকে ফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করেন। তিনি জানান, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৭ জন গণিতে ফেল করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার ফলাফল গতকাল ঘোষণা করা হয়েছে। সিলেটে পাশের হার ৭৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সিলেট বোর্ডে এ বছর ১ লাখ ৯ হাজার ৭৩ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে পাশ করেছে ৮০ হাজার ৬ জন শিক্ষার্থী। ফেল করেছে ২৯ হাজার ৬৭ জন । এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫ হাজার ৪৭১ জন।