কানাইঘাটে ৪ জনের প্রাণহানির নেপথ্যে মসজিদের ৫ শতক ভূমি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ মে ২০২৪, ১১:৫৪:২১ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
সাত ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই সামছুল হক গ্রামের মসজিদের মাত্র আড়াই লাখ টাকা মূল্যের পাঁচ শতক জমি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আছেন। ওই জমিতে নতুন স্থাপনা তৈরি করা হবে; তাই ছাড়তে হবে মসজিদের মালিকানাধীন ওই জমি। ওই জমি নিয়ে মসজিদের পক্ষে কথা বলায় আপন বড় ভাই ও ভাতিজারা ধারালো দা দিয়ে প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে স্বজনদেরকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। রক্তে ভেসে যায় বসতবাড়ির সামনের ছোট্ট সড়ক। ভাই-ভাতিজাদের হাতে একে একে খুন হন জয়নাল আবেদীন (৪৬), ছয়ফুল্লাহ (৬২) আর আব্দুল্লাহ (৫৫) নামের তিন সহোদর। শ্বশুরবাড়িতে স্বচক্ষে এমন রোমহর্ষক কান্ড দেখে স্ট্রোকে মারা যান পুত্রবধূ রোমানা বেগমও (২৮)। সম্প্রতি সংঘটিত ওই সিরিজ হত্যাকান্ডের ঘটনায় শোকে স্তব্ধ সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার হারাতৈল মাজবড়াই গ্রাম। সেখানে বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। ঘটনার পর চার ঘাতককে গ্রেফতার করা হলেও বাকি ৮ আসামী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশ বলছে, প্রধান আসামিসহ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেফতারেও অভিযান চলছে।
যেভাবে ভাই-ভাতিজাদের হাতে খুন হলেন ৩ ভাই
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কানাইঘাট উপজেলার বড় চতুল ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের হারাতৈল মাজবড়াই গ্রামের মসজিদের প্রায় পাঁচ শতক ভূমি দীর্ঘদিন ধরে মো. সামছুল হক দখল করে আছেন। সম্প্রতি মসজিদের ইমাম থাকার জন্য হুজরাখানা নির্মাণ করতে গ্রামের প্রবাসে থাকা লোকজন পাঁচ লাখ টাকা পাঠান। প্রবাসীদের দেয়া টাকায় গ্রামের লোকজন নতুন স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ নেন। ঘটনার দিন গেল ২২ এপ্রিল শুক্রবার মসজিদে বিষয়টি নিয়ে মুসল্লিগণ আলোচনা করেন। এ সময় মসজিদের ভূমি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে সামছুল হককে অনুরোধ জানান তারা। সামছুলের সহোদর জয়নালকে এর দায়িত্ব দিয়ে মুসল্লিগণ মসজিদ থেকে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যান। দায়িত্ব পেয়ে জয়নাল ভূমি ছেড়ে দিতে তার ভাইকে অনুরোধ করেন।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সামছুলের স্ত্রী খুদেজা বেগম তার পুত্রদেরকে ডেকে এনে জয়নালকে উচিত শিক্ষা দিতে বলেন। মুহূর্তেই চার পুত্রসহ সামছুল ধারালো দা দিয়ে জয়নাল আবেদীনকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করেন। জয়নালের আর্তচিৎকারে সহোদর ছয়ফুল্লাহ, আব্দুল্লাহসহ স্বজনরা ছুটে আসেন। ঠিক এ সময়ে সামছুলের সাথে আরও ধারালো দা নিয়ে হামলায় গ্রামের আরও কয়েকজন যোগ দেয়। সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পরিস্থিতির। তাদের এলোপাতাড়ি হামলায় ঘটনাস্থল আব্দুর রবের বাড়ির সামনের সড়ক রক্তে ভেসে যায়। গুরুতর আহতাবস্থায় জয়নালকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্য আহতদেরকে সিলেটের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনার পরদিন ২৩ এপ্রিল বিকেলে ৭ জনের নাম উল্লেখ করে নিহত জয়নালের পুত্র কামরুজ্জামান মুসা বাদী হয়ে কানাইঘাট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-১৫।
এদিকে, আহতদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৮ এপ্রিল সকালে একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ছয়ফুল্লাহ ও ২ মে রাতে নগরের আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে আব্দুল্লাহ মারা যান। নিহত তিনজনই হারাতৈল মাজবড়াই গ্রামের মৃত আছদ আলীর পুত্র। আছদ আলীর সাত পুত্রের মধ্যে চতুর্থ ছয়ফুল্লাহ, পঞ্চম আব্দুল্লাহ এবং সপ্তম ছিলেন জয়নাল আবেদীন। নিহত ছয়ফুল্লাহর ৩ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তান, নিহত আব্দুল্লাহ ৪ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তান এবং নিহত জয়নাল ৪ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের জনক। একে একে আপন তিন ভাই হত্যাকান্ডের ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো এলাকা।
শ্বশুরের খবরে স্ট্রোকে পুত্রবধূর মৃত্যু
নিহত ছয়ফুল্লাহর পুত্র আবু বকরের স্ত্রী রোমানা বেগম (২৮) স্বামীর বাড়িতে আসার পর থেকেই ছিলেন আদরের। শ্বশুর ছয়ফুল্লাহ তাকে নিজের কন্যার মতোই দেখতেন। নিজের সামনে এভাবে প্রকাশ্যে দিনেদুপুরে শশুরবাড়ির লোকজনকে এলোপাতাড়ি কোপানোর দৃশ্য দেখে গৃহবধূ রোমানা আর স্বাভাবিক থাকতে পারেননি।
২৮ এপ্রিল রোববার ভোররাতে হঠাৎ করে স্ট্রোক করেন রোমানা। স্বামী-স্বজনরা তাকে দ্রুত কানাইঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুত্রবধূর এমন মৃত্যুর ঠিক ছয় ঘণ্টার মাথায় মারা যান শ্বশুর ছয়ফুল্লাহও।
রোমানার স্বামী আবু বকর জানান, স্বচক্ষে এমন রক্তপাত দেখে রোমানা স্বাভাবিক থাকতে পারেননি। পরে স্ট্রোক করে তিনি মারা যান। তার ইব্রাহিম নামের আট বছরের এক পুত্র সন্তান রয়েছে।
ধারালো দা দিয়ে শুধু এলোপাতাড়ি কোপ
বর্বর এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে গ্রামের বয়ো:বৃদ্ধ আব্দুর রশীদ (৬৫) বলেন, জুমার নামাজ শেষে জমির বিষয়ে আলোচনার পর আমরা নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাই। জমির বিষয়ে সাবেক মেম্বার জয়নালকে দায়িত্ব দেয়া হয়। হঠাৎ শুনি শোরগোল-চিৎকার। দৌড়ে গিয়ে দেখি, সামছুল ও তার ছেলেসহ কয়েকজন জয়নাল মেম্বার ও তার ভাইদেরকে শুধু দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। এ সময় ওই স্থান রক্তে ভেসে যায়। এ ধরনের বর্বর ঘটনা জীবদ্দশায় দেখেননি বলে মন্তব্য করেন এই বয়ো:বৃদ্ধ।
৭ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে
ঘটনার দিন রাতে ওসমানী হাসপাতাল থেকে সামছুল হক (৬৫) এবং তার দুই পুত্র সোহেল আহমদ (২৩) ও কামাল উদ্দিন (৩২) ও খলিল উদ্দিন (৪০) নামের চার ঘাতককে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত চারজনই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। পরবর্তীতে জসিম উদ্দিন ওরফে জসাই নামের আরেক আসামিকেও গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও গ্রেফতারকৃত সামছুল হকের পুত্র আলমাছ উদ্দিন (৩৫) ও রুহুল আমিন (৩০), একই গ্রামের নাছির উদ্দিনের পুত্র কামাল আহমদ (৩০), মছব্বিরের পুত্র রফিকুল ইসলাম (৬০), দলকিরাই গ্রামের আব্দুল হকের পুত্র ফখরুল ইসলাম মুনাই (৫৫), হারাতৈল মাজবড়াই গ্রামের সামছুল হকের স্ত্রী খুদেজা বেগম ও কামাল আহমদের স্ত্রী রসনা বেগম ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছে বলে মামলার বাদী কামরুজ্জামান মুসা সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন।
মুসা বলেন, এরা সবাই সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছে।যেকোনো মূল্যে উপরোক্ত ঘাতকদের গ্রেফতার করতে তিনি আইনশৃঙ্কলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি দাবি জানান।
পাঁচ শতক জমি নিয়ে ঝরলো তিন প্রাণ
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গ্রামের জামে মসজিদের সীমানার সাথে লাগোয়া বাড়িটির মালিক হলেন সামছুল হক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মসজিদের প্রায় পাঁচ শতক ভূমি দখল করে রেখেছেন। এ নিয়ে বহুবার আলোচনা হলেও সময়ক্ষেপণ করছিলেন সামছুল হক ও তার পুত্ররা। স্থানীয়ভাবে প্রতি শতক ভূমির দাম সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এই হিসেবে পাঁচ শতক জমির দাম সর্বসাকুল্যে দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা। আড়াই লাখ টাকা মূল্যের পাঁচ শতক জমির জন্যে নিজের মায়ের পেটের তিন ভাইকে হত্যা করে ফেলে সামছুল হক।
মসজিদের মুতাওয়াল্লি মুহাম্মদ আব্দুল খালিক বলেন, পাঁচ শতক জমির জন্য তিন ভাইকে খুন করা হয়। মসজিদের ভূমি ছেড়ে দিচ্ছি-দেব বললেও সামছুল কখনো ওই জমিটুকুর দখল ছাড়তে রাজি হননি।
বাদী মুসার অজানা আতঙ্ক
নিহত জয়নাল আবেদীনের পুত্র ও হত্যা মামলার বাদী কামরুজ্জামান মুসা ঘটনার পর থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছেন না। নিজের মাঝে বিরাজ করছে এক অজানা আতঙ্ক। কেবল মুসা নয়; তাদের বাড়ির সবার মাঝে বিরাজ করছে আতঙ্ক।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে মুসা বলেন, আপন চাচা ও চাচাতো ভাইরা মিলে আমার পিতা-চাচাদের হত্যা করবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। খুনীরা এখনো পলাতক রয়েছে। তারা যেকোনো মুহূর্তে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি সাধন করতে পারে বলে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি সকল আসামিদেরকে দ্রুত গ্রেফতার করে যথাযথ তদন্ত করে ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান।
তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কানাইঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উজায়ের আল-মাহমুদ আদনান গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিলেটের ডাককে মসজিদের জমি দখল নিয়ে বিরোধে তিনজন এবং স্ট্রোকে একজন নারীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, প্রথমে জয়নাল হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে ছয়ফুল্লাহ ও আব্দুল্লাহ হত্যার বিষয়টি আদালতকে আবেদন করে অবগত করা হয়। তিন খুনের ঘটনা একই মামলায় তদন্ত করা হবে। ঘটনার পর প্রধান আসামিসহ পাঁচ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এজাহার নামীয় আরও দুই আসামি পলাতক আছে। এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামিও রয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, বাদীর নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই। নিহত তিনজনের পরিবারকে পুলিশ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিচ্ছে বলেও জানান তিনি।