সুরমা রিভারভিউ মডেল সিটি
সিলেটে দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চার লন্ডন প্রবাসী বিপাকে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ মে ২০২৪, ৭:৪৮:১৭ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী :
সিলেটে সুরমা রিভারভিউ মডেল সিটি নামক একটি হাউজিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে এক চিকিৎসকসহ চার লন্ডন প্রবাসী বিপাকে পড়েছেন। পনের বছর আগে এক কোটি পয়ত্রিশ লাখ টাকা অর্থ বিনিয়োগ করে আজও প্লট পাওয়া দূরের কথা ওই টাকার কোনো হদিস মিলেনি। প্রপার্টি লিমিটেডর নামে ওই কোম্পানিটি বছরের পর বছর ধরে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের হয়রানি করছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী প্রবাসীরা বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পেতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
জানা গেছে, মাওলানা এনামুল হক ও মো. নিজাম উদ্দিনসহ কয়েকজন উদ্যোক্তা মিলে সিলেট শহরতলীর মিরেরচক এলাকায় সুরমা রিভারভিউ মডেল সিটি নামক একটি হাউজিং প্রকল্প করেন। এর নাম দেয়া হয় প্রপার্টি বিজনেস প্রা. লিমিটেড। কোম্পানির উদ্যোক্তারা এতে বিনিয়োগ করাতে প্রবাসীদের টার্গেট করেন। তারা প্রবাসীদের সাথে ওই হাউজিং প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে নানান অফারও দেন। তাদের চমকপ্রদ লোভনীয় অফারে জগন্নাথপুরের বাসিন্দা লন্ডন প্রবাসী ব্যবসায়ী এস আই আজাদ আলী ২০০৯ সালের ২০ মার্চ ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগ করার পরপরই প্রবাসী আজাদ আলীকে রাতারাতি কোম্পানির চেয়ারম্যানের পদ দেয়া হয়। এরপর এস আই আজাদ আলীর পূর্ব পরিচিত যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুস শহীদ ২৫ লাখ টাকা, মুজিবুর রহমান ২৫ লাখ টাকা, শামীম উদ্দিন উকিল ৩০ লাখ টাকা ও চিকিৎসক আমিনুর রহমান লস্কর ২৫ লাখ টাকা এই হাউজিং প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন।
ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারী এস আই আজাদ আলী সিলেটের ডাককে ঘটনার আদ্যপ্রান্ত বর্ণনা করে বলেন, পাঁচ বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করে হাউজিং প্রকল্পে সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নেন। এরই মধ্যে ধরা পড়ে হাউজিং প্রকল্পের জমি কোম্পানির নামে দলিল না করে মাওলানা এনামুল হক ও নিজাম উদ্দিনের নামে বহু দলিল রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এছাড়াও প্রকল্প নিয়ে উপরোক্ত দু’জনসহ আরও কয়েক জনের ছয় নয় ধরা পড়লে চেয়ারম্যান পদ থেকে এস আই আজাদ আলী ২০১০ সালে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের আগে তিনি কোম্পানির নামে দলিল না করে ব্যক্তির নামে দলিল করার প্রতিবাদও জানান। তিনি সবক’টি দলিল কোম্পানির নামে সম্পাদন করে দেয়ার অনুরোধ করলে তারা এতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর পাঁচ বিনিয়োগকারী তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত দিতে বলেন।
বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত দিতে এনামুল হক ও নিজাম উদ্দিন বার বার সময় নিলেও একটি পয়সাও তারা ফেরত দেয়নি । এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই এনামুল ও নিজামের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীরা আদালতে মামলা দায়ের করেন। এর মধ্যে এস আই আজাদ আলী ৩ মামলার বাদী আর আব্দুস শহীদ হলেন আরও এক মামলার বাদী। বর্তমানে ৪ মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলে এস আই আজাদ আলী জানিয়েছেন।
এদিকে, সিলেট নগরীর যতরপুরের বাসিন্দা লন্ডন প্রবাসী আব্দুস শহীদের দায়েরকৃত মামলার তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত শেষে পিবিআইর পুলিশ পরিদর্শক মো. গোলাম কিবরিয়া গত বছরের ২১ মে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্ণিত ১নং বিবাদী মাওলানা মো. এনামুল হক ও ২নং বিবাদী মো. নিজাম উদ্দিনদ্বয় প্রপার্টি বিজনেস (প্রাঃ) লিমিটেড নামে একটি ডিরেক্টরশীপ চুক্তিনামা সম্পাদিতক্রমে বাদীর নিকট হতে সর্বমোট পচিশ লক্ষ টাকা গ্রহণের বিষয়টি স্বীকার করতঃ বাদীর উক্ত টাকা নগদে ফেরত প্রদানে মৌখিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েও বাদীর সরলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গক্রমে বাদীর পাওনা উক্ত টাকা আত্মসাৎসহ সমুহ বিষয়টি অস্বীকার করতঃ ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে বিবাদীদ্বয় বাদীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করায় পেনাল কোড ৪০৬/৪২০/৫০৬ ধারার অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে মর্মে তদন্তে প্রকাশ পায়।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একই সাথে বিবাদীদ্বয় চুক্তিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে কোম্পানির নামে জায়গা ক্রয় না করে ২নং বিবাদীর নামে বায়না দলিল নং-৮৬৭/২০১০, ১৫০৭১/২০০৯, ৫৯৪২/২০০৯, ১৫৯৪০/২০০৯, ১৬৫৪১/২০০৯, ১৬৭২৮/২০০৯, ১১১৭/২০১০, ১৬১৮৮/২০০৯, ২০১৪৯/২০০৯, ৫৩৮৮/২০০৯, ৫৬৭৬/২০০৯, ৪৪১৬/২০০৯, ৫১৩৮/২০০৯, সাফ কবলা দলিল নং- ১৯০৪৯/২০১০, ১৭৩৫১/২০০৯, ১৭৩৫২/২০০৯, ১৭৩৫০/২০০৯, আমমোক্তারনামা দলিল নং- ৯৫৭৪/২০০৯, ১০২৩৭/২০০৯, ৯৪৫/২০১১, ১৬৭২৮/২০০৯, ৯৩২৬/২০০৯, ৯৫০২/২০০৯, ১৫৮০৭/২০০৯, ১৮০৬৭/২০০৯, ৫১৭৮/২০০৯, ৫৬৭৭/২০০৯, ৯১৬৪/২০০৯, ৯৩২৯/২০০৯, ৯৩২৮/২০০৯, ৯৩২৬/২০০৯, ৯৫৭৪/২০০৯, ৯৫০২/২০০৯ সম্পাদন করে বিবাদী পক্ষই লাভবান হয়েছেন এবং বাদীকে কোন কিছুই প্রদান করেননি এ বিষয়টিও তদন্তে প্রকাশ পায়।
প্রতিবেদনে অভিযুক্ত দু’জনের ঠিকানাও দেয়া হয়। এর মধ্যে মাওলানা এনামুল হক কুমিল্লার লাকসাম রোডের দক্ষিণ চর্খা গ্রামের মৃত মাওলানা মো. জাফরের পুত্র। বর্তমানে তিনি সিলেট নগরীর আখালিয়ায় (৩/৫ বন্ধন,আ/এ, ব্লক-১) বসবাস করছেন। আর নিজাম উদ্দিন সিলেটের বন্দরবাজারের কুদরত উল্লাহ মার্কেটের নিউ এমদাদিয়া লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী। তার পিতার নাম মৃত মাওলানা গিয়াস উদ্দিন। তদন্ত প্রতিবেদনে নিজাম উদ্দিনের স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে, ভুক্তভোগী প্রবাসী এস আই আজাদ আলী গত ১৫ এপ্রিল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর নিকট বিনিয়োগকৃত অর্থ ফিরে পেতে একটি আবেদন করেন। এতে তিনি বিনিয়োগের বর্ণনা দিয়ে ঘটনার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। তিনি এতে উল্লেখ করেন, আমার মত বহু প্রবাসীদেরকে এরা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করছে। বর্তমানে আমি আমার বিনিয়োগকৃত অর্থের জন্য কঠিন সময় পার করছি।
অপর বিনিয়োগকারী ডা. আমিনুর রহমান লস্কর বলেন, তাদের চমকপ্রদ কথায় আমরা বিনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু এত বছর পেরিয়ে গেলেও আজও প্লটের কোনো খবর নেই। তারা কোম্পানির হিসাবও দেয়নি। ফেরত দেয়নি একটি টাকাও। তাদের প্রতারণার শিকার হব কখনো ভাবিনি বলে জানান এই প্রবীণ চিকিৎসক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির সাবেক ডিরেক্টর (ফিন্যান্স) আবু তালেব মুরাদ বলেন, আজাদ আলী ও আব্দুস শহীদ নামের দু’জনের অর্থ আমার সামনেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে আমি কোম্পানি থেকে বেরিয়ে এসেছি। এরপর কি হয়েছে তা আমার জানা নেই।
প্রপার্টি বিজনেস প্রা. লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাওলানা এনামুল হক গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সিলেটের ডাককে বলেন, চার লন্ডন প্রবাসী ও একজন চিকিৎসক বিনিয়োগ করেছেন এটি সত্য। তারা বিনিয়োগ করেছেন প্লট পাওয়ার জন্যে। আমরা কয়েক মাসের মধ্যেই উনাদেরকে তাদের প্লট সমঝিয়ে দেব। আজাদ আলী এখনো কোম্পানির চেয়ারম্যান। তিনি নগদ অর্থ ফেরত নিতে চাচ্ছেন। কিন্তু কোম্পানিতো ইতোমধ্যে জমি ক্রয় করে ফেলছে। এখন অর্থ ফেরত দেব কিভাবে। তাকে তার প্রাপ্য প্লট কিছুদিনের মধ্যেই সমঝে দেয়া হবে।
আদালতে মামলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মামলার বিষয়গুলো ভিন্ন। যারা বিনিয়োগ করেছেন তারা তাদের প্লট পাবেন বলে দাবি করেন এনামুল।