গঠন হবে অনুসন্ধান কমিটি, সহযোগী শামীমা আসামি না হওয়ায় বিস্ময়
ওসমানীর সাদেক চক্রের অবৈধ সম্পদের খুঁজে মাঠে নামছে দুদক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০২৪, ৭:৫৪:১৬ অপরাহ্ন
![<span style='color:#000;font-size:18px;'>গঠন হবে অনুসন্ধান কমিটি, সহযোগী শামীমা আসামি না হওয়ায় বিস্ময়</span><br/> ওসমানীর সাদেক চক্রের অবৈধ সম্পদের খুঁজে মাঠে নামছে দুদক <span style='color:#000;font-size:18px;'>গঠন হবে অনুসন্ধান কমিটি, সহযোগী শামীমা আসামি না হওয়ায় বিস্ময়</span><br/> ওসমানীর সাদেক চক্রের অবৈধ সম্পদের খুঁজে মাঠে নামছে দুদক](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2024/05/dak-news1-1-768x480.jpg)
কাউসার চৌধুরী :
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহুল আলোচিত নার্স ইসরাইল আলী সাদেক ও তার সহযোগীদের সম্পদের খুঁজে এবার মাঠে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ লক্ষ্যে দুদক প্রধান কার্যালয়ে একটি চিঠিও পাঠানো হয়েছে। গঠন করা হচ্ছে একটি অনুসন্ধান কমিটিও।
সিলেট নগরীসহ দেশে-বিদেশে চক্রটির নামে -বেনামে কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অনুসন্ধান করে বের করা হবে। ঘুষের টাকাসহ আটকের ঘটনায় করা মামলাটিও দুদকের তফসিলভুক্ত। তাই ঘুষকান্ডের ঘটনার তদন্তও দুদক করবে। দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্রের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদক সিলেটের কৌশলি অ্যাডভোকেট লুৎফুল কিবরিয়া শামীম সিলেটের ডাককে বলেন, সাদেক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুদক আইনে মামলা দায়ের হওয়ায় আদালত তদন্তের জন্য দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন । আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী দুদক পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে জানান তিনি।
মাঠে নামছে দুদক
ওসমানী হাসপাতালের নার্স ইসরাইল আলী সাদেক ও তার সহযোগীদের দুর্নীতির বিষয়ে নড়ে চড়ে বসছে দুদক। বিপুল অর্থের দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়েরের পর আদালত অভিযোগ তদন্তে দুদককে আদেশ দেন। আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে দুদক সমন্বিত সিলেট জেলা অফিস থেকে বিষয়টির তদন্তের অনুমতি চেয়ে দুদকের প্রধান দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়। প্রধান দপ্তর থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের চিঠি আসার পরপরই দুদকের টিম মাঠে নামবে। গঠন করা হবে একটি অনুসন্ধান কমিটি। অভিযুক্তদের ও তাদের স্ত্রী, সন্তানসহ স্বজনদের সম্পদ ও সম্পদের উৎসের অনুসন্ধান করা হবে বলে দুদকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
গতকাল বুধবার বিকেলে তিনি বলেন, আদালতের আদেশের পর ইতোমধ্যে আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি। তদন্তে তাদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের পর নিয়মানুযায়ী মামলা দায়ের করা হবে।
শত কোটি টাকার সম্পদের অভিযোগ
জানা গেছে, ওসমানী হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ইসরাইল আলী সাদেক, আমিনুল ইসলাম, সুমন চন্দ্র দেব, ওয়ার্ড মাস্টার রওশন হাবিবসহ একটি শক্তিশালী চক্র দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। চক্রটির নিকট হাসপাতালের কর্মচারীরাও জিম্মি। তারা কর্মচারীদেরকে জিম্মি ও প্রতারণা করে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করে।
হাসপাতালের সরকারি ঔষধ চুরি করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছে দালাল সিন্ডিকেট।
সিলেট নগরীতে ইসরাইল আলী সাদেকের নামে ৭টি বহুতল ভবন রয়েছে। আছে স্ত্রী-সন্তানদের নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ। সাদেক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আদালতে করা মামলায় দুর্নীতির এমন ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়।
এখানেই শেষ নয়, রোগী পরিবহন, মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের কারবারের জন্য সাদেকের নামে-বেনামে অন্তত ৪০টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্সের বাজার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। ওই চক্রের সদস্য পুলিশ কনস্টেবল জনী চৌধুরী টানা ১০ বছর ধরে হাসপাতালে কর্মরত। এর ফলে তিনি নিজেও হাসপাতালের ভেতরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের সাথে সম্পৃক্ত। কনস্টেবল জনী চৌধুরীর আনুমানিক ১১ কোটি টাকা মূল্যের ২টি বহুতল বাড়ি রয়েছে।
নগরীর রিকাবিবাজারস্থ জেলা স্টেডিয়াম মার্কেটে দি ল্যাব এইড নামীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. নাজমুল হাসানও ওই চক্রের অন্যতম সদস্য। নাজমুল টেন্ডার বাণিজ্য, অনিয়ম, মাদক ব্যবসা, আবাসিক হলে রেখে ভারতীয় শাড়ির ব্যবসার পাশাপাশি আবাসিক হলে, মেডিকেল কলেজ এমনকি হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে মাদক এমনকি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবসাও করে আসছেন। চক্রটি হাসপাতালের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীদের কাছ থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক তিন হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করেন। সাদেক নিয়োগ বাণিজ্য, মহিলা নার্সদের কর্মস্থলে ও কর্মস্থলের বাইরে যৌন হয়রানি/যৌন নির্যাতন/যৌনতা/পর্ণো ভিডিও ও স্থির চিত্র তৈরি, ভুয়া বিল প্রস্তুত করে উপ-পরিচালকের নামে অর্থ আত্মসাৎ, করোনাকালে হোটেল ভাড়ার নামে অর্থ আত্মসাত, করোনা সামগ্রী ক্রয়ের নামে টাকা আত্মসাৎ, করোনায় নার্সদের নামে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ, বিভিন্ন ক্রয় ও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেন। এছাড়াও সাদেক তার নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করে রিপোর্ট কারসাজি করা, অর্থের বিনিময়ে পুলিশ কেইসের বোগীদের মেডিকেল সার্টিফিকেট টেম্পারিং করা এবং রোগীদের মেডিকেল সার্টিফিকেট টেম্পারিং করে অর্থ আত্মসাৎ করেন।
সাদেক পেশায় একজন নার্স হলেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে হাসপাতালের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী এবং অবৈধভাবে রাতারাতি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে গেছেন।
দুর্নীতিবাজ ওই চক্রের সাথে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুরু করে হাসপাতালের আরও লোকজনও জড়িত।
৮ সদস্যের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট
কেবল সাদেক একাই নয়; আট সদস্যের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এভাবেই সিলেট বিভাগের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল ওসমানী হাসপাতালকে জিম্মি করে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। সিনিয়র স্টাফ নার্স ইসরাইল আলী সাদেক (৪০) ছাড়াও মামলার এজাহার অনুযায়ী সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন- সিনিয়র স্টাফ নার্স আমিনুল ইসলাম (৪৫), সিনিয়র স্টাফ নার্স সুমন চন্দ্র দেব (৪১), পুলিশ কনস্টেবল জনী চৌধুরী (৪২), সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. নাজমুল হাসান (৩৫), ওয়ার্ড মাস্টার রওশন হাবিব (৪৬), সিকিউরিটি গার্ড আব্দুল জব্বার (৫১) ও সর্দার আব্দুল হাকিম সুমন (৪৯) ।
ওসমানী হাসপাতালের ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গত ১৭ এপ্রিল দক্ষিণ সুরমার মো. ইসলাম উদ্দিন বাদী হয়ে সিলেট মহানগর বিশেষ জজ ও মহানগর দায়রা জজ মো. হাবিবুর রহমান সিদ্দিকীর আদালতে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) তৎসহ ১৬১/১৬৪/৪০৬/৪০৯/৪২০/১০৯ দ-বিধি আইনে পিটিশন মামলা দায়ের করেন। ১৬ পৃষ্ঠার পিটিশনে চক্রটির দুর্নীতির বিশদ বর্ণনা তুলে ধরা হয়। আদালত পিটিশন মামলা আমলে নিয়ে তা তদন্ত করতে দুদককে আদেশ দেন।
সহযোগী শামীমার নাম না থাকায় বিস্ময়
এদিকে, আদালতে করা ওই মামলায় সাদেকের দীর্ঘদিনের প্রধান সহযোগী সিনিয়র স্টাফ নার্স শামীমা নাসরিনকে ১১ নম্বর সাক্ষী করা হয়েছে। একইভাবে ইতোপূর্বে সংঘটিত ঘুষকান্ডের ঘটনার মামলায়ও শামীমা নাসরিনকে সাক্ষী করা হয়। ওসমানী হাসপাতালে নার্সেস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে সাদেক ওসমানী হাসপাতালকে তার কব্জায় নিয়ে নেন। সাধারণ সম্পাদক সাদেকের সভাপতি হলেন এই শামীমা নাসরিন। নগরের অভিজাত হোটেলে বিপুল টাকা খরচ করে একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নার্সেস এসোসিয়েশন। জাঁকজমকপূর্ণ এ সকল আয়োজনে সাদেকের মূল সহযোগী ছিলেন শামীমা। তিনি সবকটি অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে মূল নেতৃত্বও দেন। শামীমা-সাদেকের ছবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরে যায়। কিন্তু একই মামলায় সাদেককে আসামি আর শামীমা নাসরিনকে সাক্ষী করায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি সরকারের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী, গোয়েন্দা সংস্থা এমনকি দুদকের নিকটও এই বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্তেরও দাবি জানিয়েছেন।
ঘুষকান্ডের ঘটনাও দুদকের তফসিলভুক্ত
চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে ওসমানী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একটি কক্ষে ৬ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণকালে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স আমিনুল ইসলাম ও সুমন চন্দ্র দেবকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা হাতেনাতে আটক করেন। কিন্তু, ঘটনার মূলহোতা আরেক সিনিয়র স্টাফ নার্স ইসরাইল আলী সাদেক পালিয়ে রক্ষা পান। পরবর্তীতে এই তিনজনের বিরুদ্ধে হাসপাতালের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়। হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স গীতা রাণী হালদারের ৮ বছরের এরিয়ার বিলের ৩৪ লাখ টাকা তুলতে চাইলে সাদেক আমিনুল ও সুমন দেব তার কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। এ ঘটনায় হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ হানিফ বাদী হয়ে পরদিন কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে আটকের বিষয়টি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ বলে জানিয়েছেন দুদকের এক কর্মকর্তা। গতকাল তিনি বলেন, এ বিষয়ে আদালতে দুদকের মতামত দেয়া হয়েছে। এ মামলায় বর্তমানে সাদেক, আমিনুল ও সুমন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে।