নদ-নদীর পানি ৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের ৪ উপজেলায় বন্যা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০২৪, ৮:০২:২৫ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার: টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে সিলেটে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে জেলার জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। সীমান্তবর্তী উপজেলা জৈন্তাপুরে সারি গোয়াইন ওয়াপদা বেড়িবাঁধ প্রকল্পের চারটি অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ঢল নেমে জৈন্তাপুর উপজেলা সদরের বাসা-বাড়িতে পানি উঠেছে। গতকাল বুধবার রাত ১১টা পর্যন্ত প্রবল বেগে পানি ঢুকছিলো। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করতে বিজিবিসহ রাজনৈতিক কর্মীরা মাঠে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানির কারণে জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলার হাওর ও নিম্নাঞ্চল এরইমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। উপজেলাগুলোর বেশ কয়েকটি রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক সড়কে যান-চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ ইতোমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া শুরু করেছেন।
গোয়াইনঘাট থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা মনজুর আহমদ জানান, গোয়াইনঘাট উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন। টানা তিনদিনের বৃষ্টি আর উজান থেকে সারি ও পিয়াইন নদী দিয়ে আসা ঢলে উপজেলার সবক’টি ইউনিয়নের ৮০ ভাগ বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।
এলাকাবাসী জানান, মঙ্গলবার সকাল থেকে একটু একটু করে পানি বাড়তে শুরু করে। তবে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। বুধবার দুপুরের পর থেকে সারী ও পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ৮০ভাগ ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। উপজেলার পূর্ব জাফলং, পূর্ব আলীরগাঁও, পশ্চিম আলীরগাঁও, মধ্য জাফলং, পশ্চিম জাফলং, সদর, রস্তমপুর, বিছনাকান্দি, তোয়াকুল, লেঙ্গুড়া, ডৌবাড়ী, নন্দীরগাঁও ইউনিয়ন সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। ফতেহপুর ইউনিয়নের আংশিক প্লাবিত হয়েছে। সারী-গোয়াইন, গোয়াইন-সালুটিকর সড়কসহ সবগুলো সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে, বিদ্যুৎ না থাকায় মানুষ অন্ধকারে রয়েছেন, আরও কিছু পানি বাড়লে অতীতের সকল রের্কড ভাঙবে- এমনটা মনে করছেন বাসিন্দারা। অনেক জায়গায় পানিবন্দি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। এছাড়া, ফিসারির মাছ, রোপা আউশ, আউশের বীজতলা এবং সব্জি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পিআইও শীর্ষেন্দু জানান, সন্ধ্যা ৬টার তথ্য অনুযায়ী পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ৪১ সেঃমিঃ উপর দিয়ে, গোয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ১২ সেঃমিঃ উপর দিয়ে এবং সারী নদীর পানি বিপদসীমার ৯১ সেঃমিঃ উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। উপজেলায় বিভিন্ন ইউনিয়নে ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
জৈন্তাপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা নূরুল ইসলাম জানান, জৈন্তাপুরে দ্বিতীয় দিনে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলা সদরে পানি ঢুকে পড়েছে।
সারী, বড় নয়াগাং ও রাংপানি নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। বুধবার রাতে উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে। সারি গোয়াইন ওয়াপদা বেড়িবাঁধ প্রকল্পের চারটি অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। জৈন্তাপুর উপজেলা সদরের বাসা-বাড়িতে পানি উঠেছে। বুধবার রাত ১১টা পর্যন্ত প্রবল বেগে পানি ঢুকছিলো। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করতে বিজিবিসহ রাজনৈতিক কর্মীরা মাঠে রয়েছেন।
রাত ১২টায় জৈন্তাপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাহেদ আহমদ ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেন ‘কেউ নিজপাট ময়নাহাটি মাঝের টুকে একটি নৌকা পাঠান, কিছু লোক আটকা পড়েছেন।’ এভাবে আটকে পড়াদের উদ্ধারে নানা আকুতি ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জৈন্তাপুর প্রেসক্লাব সভাপতি নূরুল ইসলাম জানান, প্রেসক্লাবে পানি ঢুকেছে। পুরো এলাকা ঢলের পানিতে ডুবে গেছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন নিজপাট, জৈন্তাপুর ও চারিকাটা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা। এদিকে, প্রশাসনের কর্মকর্তারা বন্যা পরিস্থিতির খোঁজ খবর রাখছেন ।
নিজপাট লামাপাড়া, বন্দরহাটি, ময়নাহাটি, জাঙ্গালহাটি, বড়খেল, মেঘলী, তিলকৈপাড়া, ফুলবাড়ী, নয়াবাড়ী, হর্নি, বাইরাখেল, গোয়াবাড়ী, ডিবির হাওর, ঘিলাতৈল, মুক্তাপুর, বিরাইমারা হাওর, খারুবিল, লামনীগ্রাম, কাটাখাল, বাউরভাগ, চাতলারপাড়, ডুলটিরপাড়, ১নম্বর লক্ষ¥ীপুর, ২নম্বর লক্ষ্মীপুর, আমবাড়ী, ঝিঙ্গাবাড়ী, কাঁঠালবাড়ী, নলজুরী, কেন্দ্রী, থুবাং, কালিঞ্জি, লালা, তুমইর, শেওলারটুক, বাওন হাওর প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলার সর্ববৃহৎ সারী, বড় নয়াগাং ও রাংপানি নদীর পানি বিপদসীমার দশমিক ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সারী-গোয়াইন বেড়িবাঁধ প্রকল্পের কর্মকর্তা মো. আলা উদ্দিন বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত থাকায় পানি জনপদের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। আমরা বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং নিম্নাঞ্চলের জনসাধারণ ও গবাদি পশু নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনতে বলা হয়েছে। এছাড়া, জনসাধারণকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, বন্যার্ত মানুষদের জন্য কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৩৫টি, গোয়াইনঘাটে ৫৬ টি, জৈন্তাপরে ৪৮টি ও কানাইঘাটে ১৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উপজেলাগুলোর হাওরাঞ্চলের বাড়িঘরের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গোয়াইনঘাট উপজেলার সারিঘাট-গোয়াইনঘাট, গোয়াইনঘাট-রাধানগর-জাফলং ও সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক প্লাবিত হওয়ায় রাস্তা দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বাকি উপজেলাগুলোতেও সড়ক ডুবু ডুবু অবস্থায় রয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া সহকারী শ্রী নিবাস দেবনাথ জানান, বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিলেটে ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৮.১ ও সর্বনিম্ন ছিল ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। আজ রাতেও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট অফিস জানায়, বুধবার সিলেটের ৫ টি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে ১১.৯৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বুধবার সন্ধ্যায় বিপদসীমা অতিক্রম করে ১৩.৯৫ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারার অমলসীদ পয়েন্টে বিপদসীমা ১৫.৪০ সে: মি: হলেও সন্ধ্যায় ১৬.৬০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সারি নদী বিপদসীমার ১২.৪৫ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সন্ধ্যায় সারিঘাট পয়েন্টে ১৩.২৬ সে.মি., ডাউকির বিপদসীমা ১৩ সে.মি. হলেও সন্ধ্যায় জাফলং পয়েন্টে ১৩.৪১ সে.মি. ওপর দিয়ে এবং সারি-গোয়াইনের গোয়াইনঘাট পয়েন্টের বিপদসীমা ১০.৮২ সে: মি: হলেও ১০.৯৪ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টিপাত বাড়ার কারণে বাংলাদেশে সিলেটের নদ-নদীর পানি বাড়ছে। ৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে পানি। তবে নিম্নাঞ্চলের পানি কিছুটা কমেও যাচ্ছে। আশা করা যায়- এভাবে পানি নামলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। তবে সময় লাগবে পরিস্থিতির উন্নতি হতে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, ১৩টির মধ্যে ১২টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আসা শুরু করেছেন। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছি এবং মাঠে আছি।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনঞ্জিত কুমার চন্দ বলেন, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আমরা মাইকিংও করেছি। আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে কারো অসুবিধা হলে আমাদের ভলান্টিয়াররা গিয়ে আনবেন।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, অনেক অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নিজপাট ইউনিয়নের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ইতোমধ্যে মানুষ উঠা শুরু করেছেন। বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আজকের রাত গেলে বুঝা যাবে।
কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরীন বলেন, বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ১৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আমরা সব জায়গার খবর রাখছি।