কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি
জকিগঞ্জে সুরমা-কুশিয়ারার ডাইক ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জুন ২০২৪, ১:২৫:২১ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার : সিলেটের কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও অবনতি হয়েছে জকিগঞ্জে। কয়েকটি স্থানে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ডাইক ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল। বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করছে ঢলের পানি। জেলার সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তিনটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর বাইরে অন্যান্য নদ-নদীর পানি কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢল না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, সিলেট নগরীর পাশ দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর পানি নালানর্দমা দিয়ে ঢুকে গত বৃহস্পতিবার রাতে নগরের তালতলা, মেন্দিবাগ ও মাছিমপুর এলাকায় জলাবদ্ধতার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। গতকাল শুক্রবারও এসব এলাকায় একই পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।
সিলেট সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার পরিবার। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র, কাউন্সিলর ও কর্মকর্তারা। গতকাল বিকেলে নগরীর ১৫, ২২ ও ২৪নং ওয়ার্ডের, সুবহানীঘাট, উপশহর, তেররতন এলাকা পরিদর্শন করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো: মখলিছুর রহমান কামরানসহ সংশ্লিষ্টরা। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতোমধ্যে সিসিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
জকিগঞ্জ (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, জকিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ডাইক ভেঙে যাওয়ার কারণে সময় সময় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে উপজেলা স্বাস্ব্য কমপ্লেক্সে, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, জকিগঞ্জ-শেওলা সড়ক, জকিগঞ্জ-সিলেট সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জকিগঞ্জ পৌরসভার একটি অংশসহ উপজেলার প্রায় ৮ টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। তবে বেশি প্লাবিত হয়েছে জকিগঞ্জ, খলাছড়া, বিরশ্রী ও কাজলসার ইউনিয়ন। এতে প্রায় দেড় লক্ষাধিক লোক বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় উপজেলায় ৫৫ টি আশ্রয় কেন্দ্র চালু হয়েছে। নদীতে পানি কিছুটা কমলেও লোকালয়ে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনো উপজেলার কোথাও কোথাও ডাইক উপচে লোকালয়ে পানি আসছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ভারত সীমান্তবর্তী ভারতের বরাক নদ থেকে প্রবল বেগে পানি এসে আমলসীদ ত্রিমোহনা দিয়ে জকিগঞ্জের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে ঢুকছে। এতে উপজেলার অনেক এলাকার সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ডাইক ভেঙে অর্ধ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। জকিগঞ্জ-সিলেট সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি পেলে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বন্যা কবলিত এলাকার মাছের ঘের, ফিসারি ও পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। গরু-ছাগলসহ গৃহপালিত পশু পাখির খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেকের ঘর কোমর পানিতে ডুবে গেছে। বিশুদ্ধ পানিরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসনিম জানান, বন্যাকবলিত এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আহবান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫৫ মোট্রক টন চাল মজুদ রয়েছে। এরমধ্যে ৩২ টন বিতরণ করা হয়েছে। ২শ শুকনো খাবারের প্যাকেটও বিতরণ হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জেলা প্রশাসককে চাহিদা জানিয়েছেন।
কোম্পানীগঞ্জ (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। টানা বর্ষণের কারণে গত বৃহস্পতিবার রাতে পানি বেড়েছিল। গতকাল শুক্রবার সারাদিন বৃষ্টি হয়নি। এ কারণে নতুন করে পানি না বাড়লেও বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। উপজেলা পরিষদ মাঠ, থানা রোড ও থানা কম্পাউন্ডে পানি প্রবেশ করেছে। গ্রামীণ রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। উপজেলার সর্বত্র গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুঞ্জিত কুমার চন্দ বলেন, বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ৬০ মেট্রিক টন চাল ও ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও বরাদ্দ দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
কানাইঘাট (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, কানাইঘাট উপজেলায় উজান থেকে নেমে আসা আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়ার পর কমতে শুরু করেছে বানের পানি। এখনও সুরমা ডাইকের ভাঙন দিয়ে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১৪৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও শুক্রবার বিকেল ২টার দিকে তা কমে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
গত বুধবার পাহাড়ি ঢলে সুরমা নদীর বিভিন্ন এলাকায় ডাইক ভেঙে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে পৌর শহর সহ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকার রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান, হাজারো বাড়ি-ঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার রাত থেকে সুরমা ও লোভা নদীর পানি কমতে শুরু করলে পৌর শহর সহ আশপাশ এলাকা বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হলেও প্রত্যন্ত এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে এখনও হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্বিসহ জীবন-যাপন করছেন। যেসব এলাকার উচুঁ স্থান ও ঘর-বাড়ি থেকে পানি কমে গেলেও জলাবদ্ধতার কারণে বানের কাদা পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এখনও শত শত মানুষ গবাদি পশু ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বন্যা কবলিত বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র সহ উঁচু এলাকায় অবস্থান করছেন। পানি কমার সাথে সাথে কাঁচা ঘর-বাড়ি ভেঙে পড়ছে এবং পানিবাহিত রোগ ব্যাপক হারে ছড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়ার পূর্বেই সুরমা নদীর ভাঙন কবলিত ডাইকগুলো দ্রুত মেরামত করার জন্য সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী গত বৃহস্পতিবার বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত বানভাসি মানুষের খোঁজ-খবর নেন এবং শুকনা খাবার বিতরণ করেন।
অপরদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরিন, থানার অফিসার ইনচার্জ জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার বন্যা দেখা দেয়ার পর থেকে বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে বানভাসি মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ সহ খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।
এদিকে আগামী ৫ জুন কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। গোটা উপজেলার অধিকাংশ এলাকা এখনও বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের অনেকেই নির্বাচনী প্রচারণা বাদ দিয়ে তাদের সমর্থকদের সাথে নিয়ে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের খোঁজখবর নেয়াসহ তাদের মধ্যে শুকনো খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে দেখা গেছে। তাছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বন্যা দুর্গতের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
গোয়াইনঘাট (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়েছে গোয়াইনঘাটের অধিকাংশ এলাকা। এতে অসহায় হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং এ কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও ব্রিজ-কালভার্ট সমূহ পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: তৌহিদুল ইসলাম। মধ্য জাফলং, পূর্ব জাফলং, লেংগুড়া, সদর ইউনিয়ন, পূর্ব আলীরগাঁও, ডৌবাড়ি, পশ্চিম আলীরগাঁও এলাকা ইতোমধ্যে সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো শফিকুল ইসলাম, উপজেলা কৃষি অফিসার রায়হান পারভেজ রনি, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জামাল খান, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শীর্ষেন্দু পুরকায়স্থ সমন্বয়ে গঠিত টিম।
এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জরুরি ভিত্তিতে সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য ইমরান আহমদের নির্দেশনায় ১৩টি ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণের মাধ্যমে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যার্তদের জন্য ইতোমধ্যে জরুরি সহায়তা হিসেবে ৩৯ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
জৈন্তাপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, টানা তিনদিন প্লাবিত থাকার পর জৈন্তাপুরের বন্যা কবলিত স্থানগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। পানি যত কমছে, ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ততই ভেসে উঠছে। নষ্ট হয়ে গেছে বিভিন্ন সড়ক, দোকানের মালামাল, ভেঙে গেছে সড়ক, ভেসে গেছে মাছের ঘের। উপজেলায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যে থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় উপজেলার গ্রামীণ রাস্তাসহ উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রধান প্রধান সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ পরিদর্শন করেছেন।
দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, তিন দিনের টানা বৃষ্টিপাত ও ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গতকাল শুক্রবার ভোর থেকে প্লাবিত হয়ে পড়েছে দোয়ারাবাজার উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সুরমা, চেলা, মরা চেলা, চিলাই, চলতি, খাসিয়ামারা ও ছাগলচোরাসহ উপজেলার সকল নদনদীর পানি। তলিয়ে গেছে হাওর, মাঠঘাট, গোচারণ ভূমি, রবিশস্য ও ইরি বোরো ফসলি জমি। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা বগুলা, লক্ষ্মীপুর, নরসিংপুর, বাংলাবাজার ছাড়াও দোয়ারা সদরসহ বাকি পাঁচ ইউনিয়েেনর নিম্নাঞ্চল ও হাওরপাড়ের জনগোষ্ঠী। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে তেমন বৃষ্টিপাত না হলেও ভাটিতে পানির টান না থাকায় রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে ভয়াবহ বন্যার আশংকা করছেন উপদ্রুত এলাকার বানভাসি লোকজন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহের নিগার তনু জানান, জানমালের ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি। বন্যা মোকাবেলায় প্রশাসনিক সকল প্রস্তÍুতি জোরদার করতে আমাদের মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে।