সিলেটে আকষ্মিক বন্যা
সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে উন্নতি, শহরে অপরিবর্তিত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জুন ২০২৪, ১:৪৬:৩১ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটের কোথাও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, আবার কোথাও অপরিবর্তিত রয়েছে। সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকা এখনো জলমগ্ন রয়েছে। সরকারি হিসেব মতে, গতকাল শনিবার পর্যন্ত প্রায় সাত উপজেলার প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন। আগের দিন যার সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫ হাজার। ধীরে ধীরে আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়ছেন বানভাসী লোকজন।
জানা গেছে, গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জেলার সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর চারটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সুরমার পানি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নিচু এলাকায় ঢুকে পড়ায় মহানগরের বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ন রয়েছে। পানি বাসা ও রাস্তায় চলে আসায় মহানগরের উপশহর, সুবহানিঘাট, যতরপুর, মেন্দিবাগ, কাজিরবাজার, মাছিমপুর, তালতলাসহ বেশ কিছু এলাকার মানুষ চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন। নতুন করে বৃষ্টি না হলে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা আশা করছেন।
গতকাল শনিবার বিকেলে পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ফলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেনি। জেলার গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলায় পানি অনেকটা কমেছে। অন্যদিকে, সিলেট সদর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, সিলেটে শুক্রবার থেকে শনিবার সন্ধা পর্যন্ত তেমন বৃষ্টি হয়নি। তবে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত আছে। নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত না হলেও কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে।
সিলেট জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৯টি ওয়ার্ডসহ সদর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার ৫৯টি ইউনিয়নের ৬ লাখ ৯ হাজার ৭৩৩ জন মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে। জেলায় ৫৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। বর্তমানে আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন ৩ হাজার ৩৪২ জন। জেলার ৮টি উপজেলার মোট ৭৮১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
নগরীর ২২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফজলে রাব্বি চৌধুরী মাছুম শনিবার দুপুরে জানান, তার ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এরই মধ্যে ময়না মিয়ার কলোনী, টিলাবাড়ির কলোনী ও আই ব্লকের কলোনীতে পানি প্রবেশ করেছে। এসব কলোনীতে প্রায় ৪ শতাধিক লোক বসবাস করে। পানি আরো একটু বাড়লে তাদেরকে অন্যত্র সরাতে হতে পারে বলে জানান তিনি।
সিলেট নগীরর উপশহর এলাকার বাসিন্দা শুয়াইব হাসান জানান, সুরমায় পানি বাড়লে উপশহরে পানি উঠবে। প্রতিবছরই এই এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এবারো তাই হচ্ছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত খুব অল্প পানি কমেছে বলে জানান তিনি।
মাছিমপুর এলাকার প্রবীণ সিংহ বলেন, তার একটি ঘরে পানি ঢুকেছে। পুরো বাড়ি জলমগ্ন। আর একটু বাড়লেই ঘরে উঠে যাবে। তবে বন্যার পানি ভেঙ্গে তাকে কাজে যেতে হয় বলে জানান।
এদিকে, বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গোয়াইনঘাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতেও পানি কমতে শুরু করেছে। গত তিন দিন ধরে পানিতে ডুবে থাকা গোয়াইনঘাট-সালুটিকর সড়ক এবং গোয়াইনঘাট-জাফলং সড়ক থেকে পানি নেমেছে। অন্যান্য সড়কগুলোও ভেসে উঠছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলাটিতে তিনটি নদীর পানি এখন বিপদসীমার নিচে নেমে গেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, কালভার্টগুলো মেরামত ও সংস্কার করে জন চলাচলে উপযোগী করতে এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উপজেলার রাধানগর-জাফলং সড়কের যে অংশ পানিতে নিমজ্জিত ছিল সেগুলো ভসে উঠেছে। তবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। সেটি চলমান রয়েছে। ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে। উপজেলার বানভাসি মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। অনেকেই নিকটস্থ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে নিরাপদ উঁচু স্থাপনাতেও আশ্রয় নিয়েছিলেন। যেসব এলাকায় পানি কমছে, লোকজনও বাড়ি ফেরা শুরু করেছেন। তিনি জানান, রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তবে পানি না কমলে এর পরিমাণ নিরুপণ করা সম্ভব নয়। ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।
কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরীন বলেন, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৮টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রেই রয়েছেন। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও পানি কমছে। উপজেলা সদর থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করতে আরও দু’একদিন লাগতে পারে বলে জানান তিনি।
জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফসানা তাসলিম জানান, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। কুশিয়ারার অমলসীদ পয়েন্টে কাল থেকে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি ধীর গতিতে কমছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, উজান থেকে ভাটির দিকে পানি নামতে শুরু করায় সিলেট নগরী, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। তবে বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে শুকনা খাবার, রান্না করা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ সজীব হোসাইন জানান, সিলেটেও শুক্রবার ও শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। আবহাওয়া উন্নতির দিকে, এতে বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে বলে জানান তিনি। তিনি শনিবার সকাল ৬ টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘন্টায় ৭.৩ মিলি মিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানান।
ঘর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সিলেটে যখন বৃষ্টিপাত হচ্ছিলো, একই সময়ে ভারত থেকে পাহাড়ি ঢল নামতে থাকে। এখনো ঢল নামছে। এ সময় নদ-নদীর পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা। মূলত জেলার প্রধান দুটি নদী সুরমা, কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি উপচে একের পর এক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে ফসলের ক্ষেত, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। অসংখ্য বাসাবাড়িও হয়েছে প্লাবিত। এখনো আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে পারেননি বানভাসী মানুষ।