ক্ষুব্ধ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ॥ বালু ফেলে জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে : পরিবেশ অধিদপ্তর
এক অভিযোগে বন্ধ হয়ে গেলো সুরমা নদী খনন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০২৪, ৭:৩৮:০২ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম :
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর শুরু হওয়া সুরমা নদী খনন কাজ একটি মাত্র লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে নদীটির খনন নিয়ে ফের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, ‘নদী খননের বালু যেখানে ফেলা হচ্ছে, সেখানে না ফেলতে বলেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক)। ফলে আমরা বিকল্প জায়গা না পেয়ে কাজ বন্ধ রেখেছি।’
তবে পাউবো’র এমন অজুহাতে কাজ বন্ধে ক্ষুব্ধ সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কে আব্দুল মোমেন।
তিনি বলছেন, ‘যে কারণে নদী খনন কাজ বন্ধ করা হয়েছে, সেটি একটি অজুহাত মাত্র। কোনোভাবে মেনে নেয়ার মতো নয়।’
ভুক্তভোগীরা বলছেন, সিলেটে বন্যা, জলাবদ্ধতা একটি স্থায়ী সমস্যা। একদিন কয়েকঘণ্টা বৃষ্টি হলে শহরের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সেই জলাবদ্ধতা বন্যার মতো আচরণ করে। তখন মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না।
অন্যদিকে ২০২২ সালে ১৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা হয়েছিলো সিলেটে। সেই বন্যা অনেককে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আমলে নেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি।
২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সুরমা নদী খনন কাজের উদ্বোধন করেন ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সিলেট সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়নের চাঁনপুর এলাকায় সুরমা নদীতে এ খনন কাজের উদ্বোধন করেন তিনি।
২০২২ সালের মে ও জুন মাসে নগরীতে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। ওই সময় সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সুরমা নদী খনন, শহররক্ষা বাঁধ এবং নদী ও ছড়া-খালের উৎসমুখে স্লুইস গেট নির্মাণের দাবি উঠে। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এ নদী খননের উপর জোর দেন। এই প্রেক্ষিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড সুরমা খননে প্রকল্প গ্রহণ করে।
পাউবো সিলেট সূত্রে জানা যায়, সিলেট নগরীর কুশিঘাট থেকে লামাকাজি সেতু পর্যন্ত প্রথম দফায় প্রায় ১৮ কিলোমিটার নদী খনন করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। নদী খনন করে ঢাকার গুডম্যান এবং কনফিডেন্স নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেই কাজ চলতি বছরের জুন মাসে শেষ হবার কথা ছিলো। কিন্তু শেষ হবার আগেই খনন কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের সমস্যা নিরসনে শুরু নদী খনন কাজ হঠাৎ কেন বন্ধ করা হলো-এমন প্রশ্নের জবাবে পাউবো, সিলেট-এর নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, ‘ইতোমধ্যে ১৮ কিলোমিটারের মধ্যে ১২ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে। চলতি জুন মাসে শেষ হবার কথা ছিলো সেই কাজ। তবে হলো না। সিলেট সিটি কর্পোরেশন সেই কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে নদী পুরোদমে ভরে গেছে। এ অবস্থায় খননকাজও চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ’
সিসিকের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মখলিছুর রহমান কামরানের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন বলে জানান। কিছুক্ষণ পর আবার টেলিফোনের মাধ্যমে খনন কাজ বন্ধের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ‘২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগের ভিত্তিতে বালু ফেলা বন্ধ করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এলাকাবাসীসহ আরো কিছু সংগঠনও অভিযোগ করেছেন- নদী খননের পর বালুগুলো যেখানে রাখা হচ্ছে-সেই জায়গাটি একটি জলাশয়। বালু ফেলে সেই জলাশয় ভরাটের পাঁয়তারার অভিযোগ আনা হয়েছে একটি চক্রের বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে বালু রাখা বন্ধ রাখা হয়েছে। বালু ফেলার অভিযোগে সিলেটবাসীর ৫০ বছরের পুরনো সমস্যা সমাধানের পথ বন্ধ করে দেয়া হবে, বিকল্প কোথাও বালু রাখার জায়গা দেয়া যায় কি না- এই প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে ভারপ্রাপ্ত মেয়র বলেন, অবশ্যই, কোনোভাবেই খনন কাজ বন্ধ হতে দেবো না। আমি সবাইকে নিয়ে কালই বসবো, বিকল্প বালু ফেলার জায়গার জন্য।’
নদী খনন কাজ বন্ধ নিয়ে কথা হয় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এর সাথে। তিনি বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড একটা অজুহাতে কাজ বন্ধ করে দিলো। এই কাজ বন্ধ হলে সিলেটের বন্যা সমস্যার সমাধান না হয়ে আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। সাবেক মন্ত্রী বলেন, সিটি কর্পোরেশন এতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ কেনো বন্ধ করলো তা-ও বুঝতে পারছি না। এটা কোনোভাবে মেনে নেয়ার নয়।’
সুরমা নদী নিয়ে চলমান এই অবস্থার মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে “সিলেটের বন্যা : নাগরিক অভিজ্ঞতা ও করণীয় গোলটেবিল বৈঠক” হবে আজ। ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) ও সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে।
সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটির সদস্য আব্দুল করিম কিম এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা শুনলাম বর্ষার আগেই খনন করা হবে। বর্ষা শেষ হয়ে আরেক বর্ষা সমাগত। কাজ শেষ হয়নি এখনো। প্রকল্পের আওতাধীন ১৮ কিলোমিটারের ৮ কিলোমিটার নদী খনন হয়েছে বলাটাও কঠিন। সুরমা নদী খনন নিয়ে যা হচ্ছে তা রাষ্ট্রের অর্থের অপচয়।’
অন্যদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মহলের ভাষ্য, নদী খনন নিয়ে রাজনীতি থেকে শুরু করে কোনো মহলের চিন্তা নেই। সবার দৃষ্টি বালুর দিকে। কে কিভাবে বালু লুট করবে সেই চিন্তায় অনেকের ঘুম হারাম। তারা বলছেন, টুকেরবাজার ব্রিজের নিচ থেকে লামাকাজি কাজিবাড়ি পর্যন্ত চারটি স্থানে বালু রাখা হচ্ছে। সেই পয়েন্টগুলোতে একটি চক্র রাতের আঁধারে ড্রেজার দিয়ে বালু বিক্রি করছে। এই বিক্রির সাথে লামাকাজীর মির্জারগাঁওয়ের একজন মৎস্য ব্যবসায়ী এবং মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের সাবেক একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীরও নাম উঠেছে। খানুয়ার বাসিন্দা ওই চেয়ারম্যানসহ আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত রয়েছেন সেই বালু লুটপাটে।
কাজ বন্ধ নিয়ে কথা হয় ঢাকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কনফিডেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের অপারেশন ম্যানেজার আজিম উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, ‘কাজ বন্ধের পেছনে পরিবেশ অধিদপ্তরও রয়েছে। তারা প্রথমে জলাশয় ভরাটের অভিযোগ তুলে। অথচ কুশিঘাট মসজিদ কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের একটি চুক্তি হয়েছে বালু ফেলার আগে। তারা বলেছে, জায়গাটি মসজিদের।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদার সাথে। তিনি বলেন, উত্তোলিত বালু সরকারি সম্পদ। যেখানে ফেলা হচ্ছে, পরে সেগুলো তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। অথচ এই বালু টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করতে হয়। অন্যদিকে বালু ফেলে তারা একটি জলাশয়ও ভরাট করে ফেলছে।’
ভূমি সন্তান বাংলাদেশ-এর সমন্বয়কারী আশরাফুল কবির জানান, সুরমার খনন কাজ শেষ না হলে সিলেটবাসীর কপাল থেকে বন্যা, জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ যাবে না।