সিলেটে কমছে বন্যার পানি, বাড়ছে রোগবালাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জুন ২০২৪, ১:৪৭:৪৪ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত জেলার সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তিনটি স্থানে (পয়েন্টে) পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সার্বিক দিক থেকে বন্যা পরিস্থিরি উন্নতি হয়েছে। তবে গোলাপগঞ্জ, সিলেট সদর ও দক্ষিণ সুরমার কিছু জায়গায় বন্যার পানির বিস্তৃতি ঘটছে।
অন্যদিকে গতকাল বুধবার দুপুর পর্যন্ত সাড়ে ৪ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এরমধ্যে সিলেট নগরীর আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৪ হাজার মানুষ। নানা রোগ বালাই দেখা দিচ্ছে বন্যার্তদের শরীরে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বুধবার জানানো হয়, জেলার ১০টি উপজেলার ৭৮টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ড বন্যাকবলিত হয়েছে। প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা ৮৪২। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬ লাখ ৮৬ হাজার জন মানুষ। জেলায় ৫৭১টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। বর্তমানে আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন ৪ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে নগরেই আছেন চার হাজার।
পাউবো জানিয়েছে, বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ২৬ মিটারে অবস্থান করছিল, যা বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপরে।
এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর আমলসিদ পয়েন্টে পানি ১৫ দশমিক ৫৮ মিটারে অবস্থান করছিল, যা বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপরে। একইভাবে কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি ৯ দশমিক ৮৮ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছিল, যা বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপরে। এর বাইরে জেলার অন্যান্য পয়েন্টে নদ-নদীর পানি কমেছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বানভাসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ জায়গা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে জেলার জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলার অনেক গ্রাম ও রাস্তাঘাট এখনো প্লাবিত। সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা গোলাপগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলের কিছু এলাকা গতকাল বুধবার নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট নগরের কয়েকটি এলাকার মানুষ এখনো পানিবন্দি আছেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান আরো জানান, বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ এবং বিশুদ্ধ পানি বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। এছাড়া বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ইউনিয়নভিত্তিক চিকিৎসক দল গঠন করা হয়েছে। নতুন করে কিছু এলাকায় পানির বিস্তৃতি ঘটছে, প্রশাসন সেদিকে নজরে রাখেছে। সবাইকে সতর্ক থাকারও আহবান জানান তিনি।
অন্যদিকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। শুকনো খাবারসহ খিচুরি প্রদান করে সিসিক।
মিরাবাজারের আশ্রয়কেন্দ্র কিশোরীমোহন (বালক) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কথা হয় হেনা বেগমের সাথে। তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবারে কলোনির সবার সাথে আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন। এখানে এসে একটু থাকার ঠাঁই হয়েছে। তবে ঠান্ডা আর পঁচা পানিতে এখন জ্বর, সর্দি-কাশি ও মাথাব্যথার কারণে আর উঠতেই পারছেন না বিছানা থেকে। তিনি আরো বলেন, রোববারে একজন ডাক্তার এসেছিলেন। তিনি এক পাতা নাপা দিছেন। কিন্তু তাতে একটুও অসুখ সারেনি। সোমবার আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজন আমাকে নিয়ে গেছে ডাক্তারের কাছে। এই অবস্থায় দিন যাচ্ছে।
আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া আনোয়ারা খাতুন (৬০) ভুগছেন জ্বরে। তিনি জানান, হাত-পা বইলা উঠে। নড়তেই পারি না। অভাবের কারণে এখন চিকিৎসাও করতে পারতেছি না। শুক্রবার থেকে প্রচন্ড জ্বর। ঘরে রেখে আসছি বুক সমান পানি।
বানেছা বেগম (৪০) নামের আরেকজন জানান, তিনি বাসাবাড়িতে কাজ করেন। শনিবার থেকে জ্বর ও সর্দি-কাশিতে ভুগছেন। চিকিৎসা করাতে পারতেছেন না। এদিকে খাবারও খেতে পারছেন না।
৪ সদস্যের পরিবারের কর্তা একই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা শাওন আহমদ জানান, আমার ৭ মাসের বাচ্চা ইব্রাহিম ৪ দিন ধরে পাতলা পায়খানায় ভুগছে। প্রতিদিন একবার করে খাবার পেলেও কোনোপ্রকার ওষুধপত্র পাচ্ছি না। আগে ফিসারিতে কাজ করতাম। এখন সেটাও নাই। যার কারণে ঠিকমতো ওষুধ ও আনতে পারছি না।
নগরীর বন্যাকবলিত এলাকা উপশহর, যতরপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যেসব এলাকায় মঙ্গলবার সকালে হাঁটুপানি ছিল, সেখান থেকে সেটা নেমে গেছে। তবে নিচু এলাকার অনেক জায়গায় এখনও রাস্তায় হাঁটু সমান পানি রয়েছে। অনেকের বাসাবাড়ি থেকে পানি নামেনি। তবে বুধবার থেকে অনেকটা কমেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যায় আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে আমাদের দুটি টিম কাজ করছে। তবে এই বন্যায় মানুষ সেরকমভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন না। অনেকেই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন আর আমরাও ওষুধ দিয়ে আসছি। প্রতিদিনই আমাদের এই কার্যক্রম চলছে। বন্যা শেষে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে বিভিন্ন রোগে। সেটার জন্যও আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।’
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজিব হোসেন বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ১১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
গত ২৭ মে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। ওই দিন জেলার ৫টি উপজেলায় বন্যা কবলিত হয়। বর্তমানে ১০টি উপজেলায় রয়েছে বন্যার পানি। তবে উন্নতি হচ্ছে পরিস্থিতির।
গোলাপগঞ্জ (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতাঃ গোলাপগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়া শুরু হয়েছে। খোলা হয়েছে উপজেলা কন্ট্রোলরুম। গত মঙ্গলবার উপজেলার বন্যা আক্রান্ত শরীফগঞ্জ ও বাদেপাশা ইউনিয়ন পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নাহিদ।
জানা গেছে, অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছ। পানি অবিরত বৃদ্ধি পাওয়ায় আরো কিছু এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
জনপ্রতিনিধিরা জানান, গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাদেপাশা ও শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের কুশিয়ারা নদী তীরবর্তী এলাকা, বাঘা ইউনিয়নের নলুয়া, কান্দিগ্রাম, তুরুকবাগ,খালপার, জালালনগর, রোস্তমপুর, কালাকোনা , এখলাছপুর, বুধবারীবাজার ইউনিয়নের বহরগ্রাম কালিজুরী, বাণিগ্রাম, আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল, উপর ঘাগুয়া, লামা ঘাগুয়া, শিকপুর, শিলঘাটের একাংশ নদী তীরবর্তী কয়েকটি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে।
বাঘা ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ রাসেল আহমদ জানান, এ ইউনিয়নের নলুয়া, কান্দিগ্রাম, তুরুকবাগ, খালপার, জালালনগর, কালাকোনা, এখলাছপুর এর রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়িতেও পানি ঢুকে গেছে। সুরমার পানি অবিরত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি পেলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে।
আমুড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান কামরান হোসেন জানান, গত কয়েকদিন অবিরাম বৃষ্টিতে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল, ঘাগুয়া, শিকপুর ও শিলঘাট গ্রামের একাংশ প্লাবিত হয়ে গেছে। এরমধ্যে সুন্দিশাইল গ্রামের কয়েকটি ঘরে পানি ঢুকে গেছে। ৪/৫ টি পরিবারকে শিগগিরই আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে হবে।
এ ব্যাপারে গোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন জানান, গোলাপগঞ্জ উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের কুশিয়ারা ও সুরমা তীরবর্তী কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫৭টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উপজেলায় একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।