গোলটেবিল বৈঠকে নাগরিক সমাজের অভিমত
বন্যা থেকে সিলেটকে রক্ষায় সুরমা-কুশিয়ারা-পিয়াইন খননের তাগিদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জুন ২০২৪, ২:১৯:৪৯ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার ॥ দীর্ঘদিনেও সুরমা-কুশিয়ারা-পিয়াইনসহ সিলেটের অন্যান্য নদ-নদী খননের কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ায় ক্ষুব্ধ সিলেটের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এ প্রসঙ্গে তারা বলেন, নদী খনন না হওয়ায় সিলেট নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলাকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। তারা উন্নয়নে উপেক্ষিত সিলেটের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ে দল-মত নির্বিশেষে সিলেটবাসীকে রাজপথে নামার তাগিদ দেন। বক্তারা সুরমা নদী খননের নামে বরাদ্দকৃত ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের শ্বেতপত্র প্রকাশেরও দাবি তুলেছেন।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে গতকাল বুধবার সিলেট নগরীর একটি হোটেলে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) ও সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার-এর উদ্যোগে ‘সিলেটের বন্যা ॥ নাগরিক অভিজ্ঞতা ও করণীয়’ শিরোনামে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে সিলেট সিটি কপোরেশনের (সিসিক) সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখেন।
গোলটেবিল বৈঠকে বন্যা ও জলাবদ্ধতায় নাকাল একাধিক নাগরিক অর্থহীন উন্নয়নে অর্থ বিনাশের অভিযোগ উত্থাপন করেন। নাগরিকেরা বলেন, বন্যা ও জলাবদ্ধতা দূর করার নামে বহু আশার বাণী শোনানো হলেও সব অসার প্রমাণিত হয়েছে। সিলেট জেলার বন্যা ও মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করার তাগিদ তাদের। প্রাকৃতিক ছড়া ও খালকে ড্রেনে পরিণত করার খেসারত নাগরিকদের ভোগ করতে হচ্ছেও বলে তাদের দাবি।
সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তার বক্তব্যে ‘আমলাদের বাধা’য় সিলেটের বিভিন্ন উন্নয়ন বাস্তবায়িত না হওয়ার অভিযোগ আনেন। সিলেটের প্রকল্পের ব্যাপারে আমলাদের দৌরাত্ম এতো বেশী যে, ‘তারা চাইলে প্রকল্প হবে, না হলে হবে না।’ এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সকলের সোচ্চার ভূমিকার ওপর জোর তার। তিনি বলেন, আমাদেরকে সিলেটকে আমরা রক্ষা করতে চাই। এজন্য দলমত নির্বিশেষে সকলকে মাঠে নামতে হবে। তিনি বলেন, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে আমলারা, আর দোষ হয় রাজনীতিবিদদের। তিনি একাধিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, সিলেট এখন অভিভাবক শূন্য।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, সিলেট সকল ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সিলেট-ঢাকা ছয় লেন প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ট্রেন লাইনের সংস্কার হয়নি। সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমও শুরু হয়নি। বড় প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে সচেতন নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সিলেটের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক-এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিলেটের দাবি-দাওয়া প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে নিয়ে যেতে হবে। ২০২২ সালের বন্যার সময় প্রধানমন্ত্রী সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর প্রশংসা করেছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ধরার কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটির সদস্য সচিব শরীফ জামিলের সভাপতিত্বে আয়োজিত সভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন- সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আব্দুল করিম চৌধুরী কিম। বৈঠকে অন্যদের মধ্যে আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ সফিক, পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্টের সভাপতি মোস্তফা শাহাজান চৌধুরী, সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি মো আব্দুল জব্বার জলিল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধ্যাপক ড. জফির সেতু, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফারুক উদ্দিন, অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম, সিলেট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক সংগঠক এনামুল মুনীর, নাগরিক মৈত্রী সিলেট-এর সভাপতি এডভোকেট সমর বিজয় সী শেখর, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট-এর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল হাই আল হাদী ও নির্বাহী সদস্য মাহমুদুর রহমান ওয়েছ, ইউকে বাংলা এডুকেশন ট্রাস্ট-এর সিইও মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান সায়েম, সমাজসেবী রোটারিয়ান জাকির আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন সিলেট জেলা শাকার সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান, প্রকাশক রাজিব চৌধুরী, মেঠোসুর সম্পাদক বিমান তালুকদার, সমাজকর্মী অরুপ শ্যাম বাপ্পী ও রেজাউল কিবরিয়া, পরিবেশকর্মী রোমেনা বেগম রোজী ও আমীন তাহমীদ, শিশু-কিশোর বিষয়ক সংগঠন উষা-এর পরিচালক নিঘাত সাদিয়া প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে শরীফ জামিল বলেন, সিলেটে কখনও বন্যা হবার কথা না। যা হচ্ছে কিংবা হবে, সব জলাবদ্ধতা। অপরিকল্পিত নগরায়ন গ্রাস করেছে পুকুর, খাল, নদী ও জলাশয়। তার সাথে যোগ হয়েছে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ণ ও হাওর ধ্বংসের অভিঘাত। সিলেটে বসবাস করতে হলে এর নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ সফিক বলেন, দায়িত্বপালন কালে ভুল্ভ্রান্তি হয়। ৫০ বছর পূর্বে সিলেট পৌরসভার দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলাম। সে সময় পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা না থাকায় কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এজন্য তিনি দু:খ প্রকাশ করেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর জফির সেতু বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় যতটা না প্রাকৃতিক তারচেয়ে বেশি মানবসৃষ্ট এবং এটা যতটা না স্থানীয় সমস্যা ততটাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফারুক উদ্দিন বলেন, “বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অধ্যয়ন সম্পর্কিত বিভাগসমূহের গ্রাজুয়েটদের সমন্বয়ে নাগরিক কমিটি গঠন করে টেকসই সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ।”
প্রফেসর তাহমিনা ইসলাম বলেন, প্রকল্পের নামে যা বরাদ্দ হয় তার বড় একটা অংশ হরিলুট হয়, তিনি বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কাজে সঠিক ভাবে সমন্বয়, এ ক্ষেত্রে বন্যার সময় বিশেষ সেল গঠনের কথা বলেন।
সিলেট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বন্যার হাত থেকে সিলেটকে রক্ষায় সুরমা-কুশিয়ারা ও পিয়াইন নদী খননের দাবি তুলেন।