সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবছে নগরী
সুরমায় পানি প্রবাহে বাধা প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তর!
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুন ২০২৪, ৮:৩২:৩৬ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যের স্তরে ভরাট হয়ে গেছে দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমার তলদেশ। ফলে কমে গেছে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা। এ অবস্থায় সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি ফুলে উঠে প্রায়শঃ ডুবছে সিলেট নগরী। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), পরিবেশ কর্মী ও ভুক্তভোগী লোকজনের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সুরমা নদীতে পলিথিনের স্তর পড়ার বিষয়টি খোদ পাউবো, সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ নিশ্চিত করেন। আলাপকালে সিলেটের ডাককে তিনি জানান, সিলেট সিটি কর্পোরেশন(সিসিক)-এর আওতাধীন এলাকা বিশেষ করে শাহজালাল ব্রীজ, কীন ব্রীজ ও কাজিরবাজার ব্রীজ এলাকায় পলিথিন সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকায় পলিথিনের ঘনত্বও সবচেয়ে বেশি। এসকল এলাকায় নদীর তলদেশে মাটির সাথে পলিথিন মিশে গেছে। এ যেন মাটির জীবন এখন পলিথিন হয়ে যাওয়ায় মতো। নদীর তলদেশে কেবল পলিথিন আর পলিথিন। যতই খনন হচ্ছে, ততই পলিথিন বেরিয়ে আসছে।
পাউবোর বিভিন্ন সময়ের সমীক্ষার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন , পলিথিন আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে বা অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে নদীতে প্রকাশ্যে পলিথিন ফেলা হয়। লোকজন চোখ বন্ধ করে নদীতে পলিথিন ফেলে দেন। বিশেষ করে রাতের বেলায় রেস্টুরেন্টের পলিথিন ফেলা হয়। যেন কারও কোনো দায়ভার নেই। কারণ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। স্বাধীনতার সর্বোচ্চটা আমরা ভোগ করি।
সুরমা খননকালে পলিথিনের উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট ড্রেজিং করার পর মেশিন বন্ধ করতে হয়। কারণ ড্রেজিং মেশিনের শক্তিশালী ফ্যানটি পলিথিনের কারণে থেমে যায়। নদীতে প্লাস্টিক -পলিথিন ফেলার বিষয়ে কঠোর হতে হবে।
সিসিকের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ একলিম আবদীন সিলেটের ডাককে বলেন , সিসিক এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ মেট্রিক টন বর্জ্য হয়। এই বিশাল পরিমাণ বর্জ্যের মধ্যে শুধুমাত্র প্লাস্টিক বা প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য ৬০ ভাগেরও বেশি। এছাড়াও ১৫ থেকে ২০ ভাগ বর্জ্য সরাসরি ছড়া বা ড্রেনে ফেলে দেয়া হয়। যার ফলে ড্রেন হয়ে স্বাভাবিকভাবেই পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য অনায়াসেই সুরমায় গিয়ে পড়ছে। এই প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে ছড়া বা ড্রেনের পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকছে না। প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলতে নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আহমদ পারভেজ জাবিন বলেন, পলিথিন বা প্লাস্টিকে মাইক্রো ফিলামেনটা নামের এক ধরনের জীবাণু থাকে। এটি মাছে খায়। এই মাইক্রো ফিলামেনটা খেলে ক্যান্সার হতে পারে। সুরমার তলদেশে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার জীবাণুর পরিমাণ কত তা জানা দরকার। স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু ঝুকিপূর্ণ তাও জানতে হবে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে তিনি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন , এক সময়ের প্রমত্তা সুরমা আজ ভরাট হয়ে গেছে। বিশেষ করে সুরমার তলদেশ পলিথিন আর প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্যের স্তর পড়েছে। সুরমার তলদেশ সঠিকভাবে ড্রেজিং করা সম্ভব হলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। এজন্য শুধুমাত্র নদীর তলদেশের পলিথিন-প্লাস্টিক জাতীয় স্তর অপসারণে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়। আবার ওই প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তার দেখভালের জন্য বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে তদারকি কমিটি করা যায়। নদী খননে অনিয়মের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বাইশের বন্যার পরে সুরমা খননে একটি প্রকল্পের কাজ ঢাক ডোল পিটিয়ে শুরু করা হয়। কিন্তু আজও সুরমার গুরুত্বপূর্ণ অংশ খনন হয়নি। কেবল বালির স্তুপগুলো অপসারণ করা হয় এবং কিছু ঠিকাদারের লাভ করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে মন্তব্য এই পরিবেশ কর্মীর।
নগরীর বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সুরমা নদীর আগের সেই নাব্যতা নেই। যে সুরমায় একসময় দেখা মিলত বড় বড় স্টীমার আর মালবাহী জাহাজের এখন সেই সুরমার অনেক এলাকা শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে যায়। আর প্রমত্তা সুরমার এখন পুরোটাই ভরাট হয়ে গেছে। বিশেষ করে সিলেট সিটি কর্পোরেশন ও সিলেট সদর উপজেলার অংশের তলদেশে পড়েছে প্লাস্টিক আর পলিথিনের স্তর।
পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করেই নগরীর বাসাবাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর সিটি কর্পোরেশনের ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবায় যাচ্ছে পলিথিন।একসময় ড্রেন থেকে পলিথিন গিয়ে পড়ছে সুরমায়। পলিথিন পড়ে ড্রেন গুলো ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।