সিলেটে এখনো সন্ধান মেলেনি ॥ বিভাগের সব হাসপাতালে পর্যাপ্ত এন্টিভেনম রয়েছে : চিকিৎসক
রাসেলস্ ভাইপার : সতর্কতার চেয়ে ভীতি ছড়াচ্ছে বেশি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৩৬:৫৭ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম :
রাসেলস্ ভাইপার। ভয়ঙ্কর এক সাপের নাম। সিলেটে বন্যার শুরু থেকে সাপটির নাম হঠাৎ করে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু ছড়ানো নয়, রীতিমতো ভীতির পাশাপাশি সাপটি নিয়ে মানুষের মধ্যে জানার আকর্ষণও বাড়ছে। ঘরে-বাইরে, সকল বয়েসি মানুষের আলোচনার টেবিলে এখন রাসেলের নাম। সিলেট বিভাগের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বন্যার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সিলেট বিভাগের কোথাও রাসেলস ভাইপার সাপ কাউকে আক্রমণ করেনি। সবগুলো জেলা এবং উপজেলার হাসপাতালে পর্যাপ্ত এন্টিভেনম মজুদ রয়েছে। একইসাথে জনসাধারণকে আতঙ্কিত না হয়ে সাবধানতা অবলম্বনের অনুরোধও তাদের।
রাসেলস ভাইপারের আরেক নাম চন্দ্রবোড়া। সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও রাসেলস ভাইপারের আতঙ্ক কাটছে না। ফেসবুকের পাতা খুললেই শুধু সাপের ছড়াছড়ি। জেনে, না জেনে অনেকেই অনেক কিছু লিখে মানুষের মধ্যে আরো বেশি ভয় জাগিয়ে তুলছেন। আবার প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সাপের বিষ কামড়ের সাথে সাথে রক্তের উপর আক্রমণ করে। ভেঙ্গে দেয় রক্ত কণিকা।
শুধু গ্রামে নয়, শহরের বন্যাকবলিত মানুষজনের কাছ থেকেও সেই সাপের আতঙ্ক যাচ্ছে না। যিনি দুতলার উপর বসবাস করছেন তিনিও মন থেকে ভীতি সরাতে পারছেন না। অনেকে সন্ধ্যার আগেই দরজা জানালা লাগিয়ে ঘরবন্দি হয়ে পড়ছেন। বিছানায় ঘুমুতে যাবার আগে বারবার ঘরের অন্দর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছেন। তারপরও রাসেল ভয় যাচ্ছে না মন থেকে। ঘরের ভেতর কোথাও একটু শব্দ হলে, চোখের সামনে এসে ভাসছে রাসেলস ভাইপারের ছবি।
মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ বলছেন, ‘বন্যার সময় সাপের আনাগোনা বেড়ে যায়, এটাই স্বাভাবিক। তবে কোথাও রাসেলস ভাইপারের খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু, আতঙ্ক এমনভাবে ছড়িয়েছে, মানুষ অজগরকে রাসেলস ভেবে মেরে ফেলছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে, রাসেলস ভাইপার কামড় দিলে নাকি এন্টিভেনমেও কাজ হয় না। আসলে এমন তথ্য ঠিক নয়। আমাদের কাছে যে এন্টিভেনম আছে, তা দিয়ে রাসেলস ভাইপারসহ যে কোনো সাপের কামড়ে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কখন বিপদ আসে তাই, আমাদের সবগুলো হাসপাতালে পর্যাপ্ত এন্টিভেনম রয়েছে।’
রাসেলস ভাইপার সাপ সাধারণত নিচু ভূমির জঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকা, ঘাসবন, ঝোঁপে বাস করে। এটি মানুষের বাসা-বাড়ি এড়িয়ে চলে। সাপটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে তখন বিপদ দেখে ভয়ে এরা আক্রমণ করে। তবে, বন্যার পর থেকে সিলেট বিভাগের কোথাও এই সাপের দেখা মিলেনি। অথচ আতঙ্কটা জঙ্গল তো দূরের কথা ঘরের বিছানা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন মো. আহম্মদ হোসেন জানান, ‘সুনামগঞ্জ প্রতিবছর বন্যায় বেশি ক্ষতির শিকার হয়। এবারও তাই হয়েছে। তবে ফেসবুকে ভীতিমূলক লেখালেখি হলেও এখন পর্যন্ত রাসেলস ভাইপার সুনামগঞ্জে কাউকে কামড় দেয়নি। তবে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। সদর হাসপাতালসহ সবগুলো হাসপাতালে এন্টিভেনম রয়েছে। তিনি বলেন, মানুষকে সচেতন করতে উপজেলা পর্যায়ে আমাদের মাঠকর্মীরাও কাজ করছেন।’
একই কথা বলেছেন সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ওসমানী হাসপাতাল, সদর উপজেলার হাসপাতালসহ সিলেটের সবগুলো হাসপাতালে এন্টিভেনম রয়েছে। দুঃশ্চিন্তার কারণ নেই। যদিও এখন পর্যন্ত রাসেলস ভাইপার সাপ কাউকে কাপড় দিয়েছে বলে আমরা খবর পাইনি। তবু আমরা প্রস্তুত। তবে আতঙ্ক না ছড়িয়ে সচেতন হওয়া সবচেয়ে বেশি জরুরি। রাতে মশারী টাঙিয়ে ঘুমানো জরুরি। রাতে চলাফেরার ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে হবে, ভয় নয়।’
সাপটি সম্পর্কে যোগাযোগ করা হয় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতান আহমেদ টিপু’র সাথে। তিনি জানান, রাসেলস ভাইপার ইংরেজি নাম হলেও বাংলায় এই সাপকে বলে চন্দ্রবোড়া। একসময় বাংলাদেশে প্রচুর ছিলো। মাঝখানে এটি কমে যায়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বেশকিছু সংগঠন এই সাপকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে আবার এই সাপের দেখা মিলছে। মূলত এগুলো ভারত থেকে আসছে। এই সাপের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি ডিম না দিয়ে বাচ্চা দেয়। ফলে বাচ্চা বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অজগর মনে করে অনেকে ধরতে যেয়ে কামড়ের শিকার হন।
এরা সাধারণত ক্ষেতে ইঁদুর খাবার জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকে। তিনি আরো জানান, সঙ্খিনী (দুমুখি), কালাজের চেয়ে রাসেলস ভাইপার কম বিষাক্ত। তবে এর বিষটা রক্তের উপর আক্রমণ করে। তার বিষ রক্তের কণিকা ভেঙে দেয়।
মাথা, কিডনি, হাঁড়ের মধ্যে চিকন যে নালী রয়েছে-সেগুলো ব্লক করে দেয় এই সাপের বিষ। তাই কামড়ের পর সাথে সাথে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সরকারি যেকোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের জন্য সুখের খবর হচ্ছে, সিলেটে এখন পর্যন্ত আসেনি রাসেলস ভাইপার। অন্যদিকে ভয়ের খবর হচ্ছে, যদি সিলেটে চলে আসে তাহলে সাপটি আশ্রয়ের প্রচুর খোলামেলা জায়গা পেয়ে যাবে। এজন্য সতর্ক থাকতে হবে।’
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, আমাদের হাসপাতালে পর্যাপ্ত এন্টিভেনম রয়েছে। তবে মনে রাখা জরুরি, যে কোনো সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনোভাবে রোগীকে ঘরে বসিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না। কেউ যদি মনে করেন, শাল্লা থেকে রোগীকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভালো চিকিৎসা পাবে, তাহলে তিনি ভুল করবেন। এসময় নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সময় বাচবে, রোগীও বাচবে। কারণ সব হাসপাতালে এন্টিভেনম রয়েছে।