সিলেট ও সুনামগঞ্জে ফের বন্যা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০২৪, ১:১৯:৩৯ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার : সিলেট ও সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার সকালে পানি কিছুটা কমেছে। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসা অব্যাহত থাকায় নদী সমূহের পানি বাড়ছে। বিভিন্ন উপজেলায় নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। কোম্পানীগঞ্জে পানিতে ডুবে গেছে উপজেলার অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক। সিলেটে তিনটি নদীর ৬টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, পাহাড়ি ঢলের কারণে তিন দিন ধরে নিমজ্জিত রয়েছে তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের দুর্গাপুর ও আনোয়ারপুর অংশ। জেলার একাধিক গ্রামীণ সড়কে পানি উঠায় উপজেলা ও জেলা শহরের সঙ্গে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এছাড়া, শুকনো খাবার ও শিশু খাদ্য মজুত রাখা হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত) ২৯৮ মি.মি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর গতকাল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৪মি.মি. বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ৪ দিন ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ৫টি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১১৬ সে.মি, কুশিয়ারার পানি আমলশীদ পয়েন্টে ৮৩ সে.মি, শেওলা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও শেরপুর পয়েন্টে পানি ২৪, ৯৭ ও ১৫ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সকালে সারি ও গোয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সন্ধ্যায় তা কমেছে।
দ্বিতীয় দফা বন্যা শেষ হওয়ার আগেই গত সোমবার থেকে সিলেটে ধাক্কা দেয় তৃতীয় দফা বন্যা। উজানে ভারী বৃষ্টির ফলে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে জেলার ১৩ উপজেলায় ৯৭টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। জেলার ১ হাজার ১৮৪টি গ্রামের ৭ লাখ ১১ হাজার ২২৬ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। জেলার ৬৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ৮ হাজার ৪০৭ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
কোম্পানীগঞ্জ : কোম্পানীগঞ্জ (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, আগের দুই দফা বন্যার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই তৃতীয় দফা বন্যার কবলে পড়েছেন কোম্পানীগঞ্জবাসী। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট এ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে উপজেলার অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক। অনেকের বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে। হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে তারা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে দেখা যায়, উপজেলা পরিষদ মাঠে হাঁটু সমান পানি। উপজেলা পরিষদ রোড, থানা রোড জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। থানা কম্পাউন্ডেও পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে পানি প্রবেশ করেছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত পানি বেড়েছে। সকালের পর আকাশে রোদের দেখা মেলে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি স্থির হয়ে আছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বিদ্যুৎ কান্তি দাস জানান, বন্যা কবলিতদের জন্য ৩৫ টি আশ্রয় কে›ন্দ্র প্রস্তুত আছে। তবে, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখনও কেউ আশ্রয় নেয়নি। তাদের জন্য ৬শ প্যাকেট শুকনো খাবার, ৩শ’ প্যাকেট শিশু খাদ্য প্রস্তÍুত করা হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুনজিত কুমার চন্দ বলেন, আগের ক্ষতি এখনও পুষিয়ে উঠতে পারেননি এ উপজেলার মানুষ। এরই মধ্যে তৃতীয় দফা বন্যা দেখা দিলো। আমরাও প্রস্তÍুত আছি এই দুর্যোগ মোকাবিলায়। আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ প্রস্তÍুত করা হচ্ছে। পানিবন্দিদের উদ্ধারের জন্য ৩৫টি নৌকা রাখা হয়েছে। ছয়টি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গোয়াইনঘাট : গোয়াইনঘাট (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, গোয়াইনঘাট উপজেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি রয়েছেন। তিনটি আশ্রয় কেন্দ্রে ৮১ জন মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভোর থেকে পানি কিছুটা কমলেও টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে সারি ও পিয়াইন নদী দিয়ে আসা ঢলে উপজেলার সবক’টি ইউনিয়নের ৬০% বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন উপজেলায় ১৫১টি গ্রাম প্লাবিত।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার তথ্য অনুযায়ী পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ১১.৫০মিটার উপর দিয়ে, গোয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ১০.৯২ মিটার উপর দিয়ে এবং সারী নদীর পানি বিপদসীমার ১২.৩২ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলায় বিভিন্ন ইউনিয়নে ৫৮টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। ইতিমধ্যে ৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৮১ জন নারী,পুরুষ ও শিশু এবং ২৯টি গবাদিপশু অবস্থান নিয়েছে।
এ রির্পোট লেখা পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির পথে রয়েছে।
কানাইঘাট : কানাইঘাট (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের ফলে তৃতীয় দফা বন্যায় কানাইঘাট পয়েন্ট দিয়ে সুরমা নদীর পানি ১১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা ও লোভা নদীর পানি গত সোমবার তীব্র গতিতে বাড়তে থাকে। গত সোমবার রাত অবধি বন্যার পানি বাড়তে থাকলেও গতকাল মঙ্গলবার সকালে পানি কিছুটা কমতে দেখা গেছে। কিন্তু গত দু’দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা ডাইকের অন্তত ১৮টি ভাঙন দিয়ে এখনও তীব্র গতিতে সুরমা ও লোভা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রত্যন্ত জনপদ বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। বন্যার পানিতে কানাইঘাট বাজারের গলিপথ এখনও তলিয়ে রয়েছে। সুরমা ডাইকের ভাঙন দিয়ে তীব্র গতিতে পানি প্রবাহিত হওয়ায় গ্রামগঞ্জের রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গিয়ে বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করছে। কানাইঘাট-দরবস্ত সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ পলাশ জানান, সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং করে বন্যা মোকাবেলায় সে অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি জানান, মওসুমের রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফের বন্যার কবলে সুনামগঞ্জের মানুষ। উজানের বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, রক্তিসহ সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে পানিবন্দি জেলার সদর, বিশ^ম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, ছাতক, তাহিরপুর ও শান্তিগঞ্জসহ ৬ উপজেলার লাখো মানুষ। রাস্তাঘাট ও বাড়ি ঘরে পানি থাকায় চরম দুর্ভোগে বানভাসিরা। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থতি অবনতি হয়ে স্বল্প মেয়াদি বন্যার শঙ্কার কথা জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে গেল ২৪ ঘন্টায় সুনামগঞ্জে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা এই মওসুমের রেকর্ড ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অতি ভারিবৃষ্টিতে সুনামগঞ্জের একাধিক পয়েন্টে সুরমা নদীর সমতল বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯ টা পর্যন্ত সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগর পয়েন্ট বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ছাড়ালেও দিনের বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি কমে গতকাল সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত ৭.৯৫ সেন্টিমিটার অর্থাৎ বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। উজানে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকায় আগামী ২৪ ঘন্টায় নদীর সমতল বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
মওসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় আগামী ৩ দিন সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে ভারি ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস জানিয়েছে সিলেট বিভাগীয় আবহওয়া অফিস। তবে বৃষ্টিপাতের মাত্রা কম হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসেন।
এদিকে, পাহাড়ি ঢলের কারণে তিন দিন ধরে নিমজ্জিত রয়েছে তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের দুর্গাপুর ও আনোয়ারপুর অংশ। সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় খেয়া নৌকা ব্যবহার করে ভোগান্তি মারিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন স্থানীয়রা। মেঘালয় পাহাড়ে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে জেলার দোয়ারাবাজার ও তাহিরপুরের বিভিন্ন সীমান্ত নদী ও ছড়া দিয়ে ঢল নেমে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের পানির চাপ বৃদ্ধি করছে। ঢলের পানিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার একাধিক গ্রামীণ সড়কসহ বন্যার পানিতে জেলার একাধিক গ্রামীণ সড়কে পানি উঠায় উপজেলা ও জেলা শহরের সঙ্গে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। দ্বিতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতিতে আতঙ্ক রয়েছেন বন্যা কবলতি এলাকার পানিবন্দি মানুষজন। যাঁরা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন নতুন করে পানি উঠায় অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় নিম্নাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের তোঁতা মিয়া বলেন, ১০ দিন আশ্রয় কেন্দ্রে থেকে বাড়িতে ফিরে গেছিলাম। কিন্তু আবারও ঘরে পানি উঠায় আবারও বাধ্য হয়ে আবারও আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে হচ্ছে। বড় একটা বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।
সুমন দাশ নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, এলাকার পথঘাট আজ দুই সপ্তাহ ধরে ডুবে আছে। মানুষ প্রকৃতির কাছে অসহায়। পর পর বন্যায় মানুষের কষ্টের সীমা নেই। যদি পানি বাড়ে তাহলে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত কম হলেও সুনামগঞ্জে অতিমাত্রায় বৃষ্টি হয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আগামী কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হবে। যদি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হয় তাহলেও ধীরে ধীরে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হবে বলে জানান তিনি।
বন্যা মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন সকল ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী। আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেয়ার পাশাপাশি পর্যাপ্ত জিয়ার চাল ও শুকনো খাবার মজুদ রাখার কথা জানান তিনি।