তদন্তে নামছে দুদক
মৌলভীবাজারে স্বাস্থ্য বিভাগে জনবল নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫:২২:১০ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী
মৌলভীবাজারে স্বাস্থ্য বিভাগের জনবল নিয়োগে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে ওই নিয়োগকালে ঘটেছে কয়েক কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য।
পতিত সরকারের মন্ত্রী এমপিদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ওই নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করে। বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় অভিযোগ করার পরেও স্বাস্থ্য বিভাগ এতে কর্ণপাত করেনি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। আলোচিত ওই নিয়োগ বাণিজ্যের তদন্তে দুদক মাঠে নামছে।
জানা গেছে, মৌলভীবাজার স্বাস্থ্য বিভাগের ওই নিয়োগকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়, মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে কর্মরত ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা চাকরির জন্য আবেদনকারীদের কাছ থেকে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেন।
ক্ষেত্র বিশেষে সিন্ডিকেট সদস্যরা দালালের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। তারা নিয়োগ কমিটিসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করতে ঘুষ বাণিজ্যের নামে অন্ততঃ ৫/৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
বিএমএর নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত ঘুষ বাণিজ্যে সম্পৃক্ত থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ভূমিকা রাখেন।
সূত্র জানায়, সরাসরি দৃশ্যপটে না এলেও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, বিএমএ নেতা ডা. সাব্বির আহমদ খান ঘটনার নেপথ্যে থেকে ওই ঘুষ বাণিজ্যের মধ্য দিয়েই পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া অতি গোপনে সম্পন্ন করেন।
নিয়োগ প্রক্রিয়া চলাকালে ডা. সাব্বির ছাড়া অন্যরা পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের মন্ত্রী এমপি ছিলেন।
কেবল এই নিয়োগই নয় এর আগে মৌলভীবাজার স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়া এমনকি আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগও ওই সিন্ডিকেট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে। বছরের পর বছর ধরে একই অফিসে কর্মস্থল হওয়ায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা দাপটের সাথেই প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্নীতি, ঘুষ ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করছেন।
সূত্র বলছে , জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ২০১৮ ও ২০২৩ সালে ৭টি ক্যাটাগরিতে দুটো পৃথক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে ৯৫টি পদের বিপরীতে ২০ হাজার ৮৬৯ জন আবেদন করেন। এরমধ্যে ৮ হাজার ১৫৪ জন লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও ৫৯৭ জন পাশ করেন। দেশব্যাপী বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ জুলাই ৯৩ জনের নিয়োগ চ‚ড়ান্ত করা হয়। প্রথম দফায় নিয়োগ পেতে ঘুষ বাণিজ্যের পর পোস্টিং এর সময় চলে আরেক দফা বাণিজ্য।
চাকরি বঞ্চিতদের অভিযোগ, নিয়োগ পরীক্ষা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বচ্ছ দেখালেও চাহিদা অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ সম্পন্ন করে স্বাস্থ্য বিভাগ। এক এলাকার আবেদনকারীকে অন্য এলাকার বাসিন্দা বানিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। ভালো পরীক্ষার পরও অকৃতকার্য হওয়ায় প্রার্থী ও তাদের স্বজনদের মাঝে নানান সন্দেহ সংশয় তৈরি হয়।
সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী অসিত চক্রবর্তী, হেড এসিস্টেন্ট কাম ক্যাশিয়ার রঞ্জনা দেবী, পরিসংখ্যানবিদ অহিজিৎ দাস রিংকু, স্টোরকিপার অলক চন্দ্র পাল ও ২৫০ শয্যা সদর জেনারেল হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সিতাংশ আচার্য্যরে নাম এসেছে।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি জনসম্মুখে আসার পর এদেরকে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হলেও দুর্নীতির বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
এমনকি নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ও তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদকে অন্যত্র বদলি করা হলেও তার দুর্নীতি-ঘুষ বাণিজ্যের ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগ এখনো রহস্যময় নীরবতা পালন করছে।
এদিকে, রাজনগর উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের গয়াসপুর গ্রামের ফিরোজ মিয়া তরফদারের পুত্র কামরুল হাসান তরফদার এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনিয়ম দুর্নীতি তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
এতে তিনি উল্লেখ করেন, মুন্সিবাজার ইউনিয়নের সাবেক ২নং ওয়ার্ডের একজন স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে তিনি স্বাস্থ্য সহকারী পদে আবেদন করেন।
গত ৭ জুন অনুষ্ঠিত মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য সহকারী পদের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়ে ১২ জুন অনুষ্ঠিত মৌখিক পরীক্ষায় সবকটি প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দেয়ার পরও তাকে নিয়োগ না দিয়ে একই ইউনিয়নের সাবেক ৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রাজু নাইডুকে চ‚ড়ান্তভাবে নির্বাচিত করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
অথচ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের শর্ত ও নির্দেশনাবলীতে স্পষ্ট বলা আছে, স্বাস্থ্য সহকারী পদের ক্ষেত্রে প্রার্থী যে ওয়ার্ডের জন্য আবেদন করবেন সে ওয়ার্ডের (পুরাতন) স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। কিন্তু দেখা যায় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে যোগ্য প্রার্থী থাকাসত্তে¡ও মুন্সিবাজার ইউনিয়নের স্বাস্থ্য সহকারীর শূন্য পদে (পুরাতন) ২নং ওয়ার্ডে একাধিক প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার পরও নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
এতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আবেদনের শর্ত পালন করা হয়নি বলে প্রতীয়মান হয় আবেদনে বলা হয়েছে ।
মৌলভীবাজার স্বাস্থ্য বিভাগের এই নিয়োগ বাণিজ্য সম্পর্কে বঞ্চিত কামরুল ইতোপূর্বে স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।
কামরুল হাসান তরফদার বলেন, তার পদে যেভাবে দুর্নীতি হয়েছে এতে অনুমান করা যায় এই নিয়োগে কি পরিমাণে ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে। ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে এই ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজে দুদকে আবেদন করে ন্যায় বিচারের দাবি করেন।
এ বিষয়ে অসিত চক্রবর্তী,রঞ্জনা দেবী, অহিজিৎ দাস রিংকু, অলক চন্দ্র পাল, সিতাংশ আচার্য্য ও রাজু নাইডুর মোবাইলে কল দেয়া হলে তাদের কেউ কল রিসিভ করেননি।
তবে মৌলভীবাজারের সাবেক সিভিল সার্জন (বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত) ও নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ সিলেটের ডাকের নিকট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো ধারণের অনিয়ম হয়নি। এক ওয়ার্ডের বাসিন্দা অন্য ওয়ার্ডে নিয়োগের বিষয় এখন মনে পড়ছে না। ঘুষ বাণিজ্যের সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিনে পয়সায় নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন বলে তিনি দাবি করেন।