আন্তঃসীমায় সুরমা-কুশিয়ারার তীব্র ভাঙন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬:১৩:০৮ অপরাহ্ন
নূর আহমদ/আব্দুল হাছিব তাপাদার: ভারতের বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী অমলশীদে এসে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। যার একটি সুরমা এবং অন্যটি কুশিয়ারা। বর্তমানে সেই দুটি নদী আগ্রাসী হয়ে উঠেছে।
বর্ষা মৌসুম শেষে আন্তঃসীমার এ নদী দুটির পানির স্তর খুব দ্রুত নিচে নামছে। এর সঙ্গে তীরবর্তী এলাকাগুলোয় ভাঙনতীব্র আকার ধারণ করছে। এর মধ্যে জকিগঞ্জ অংশে ভাঙন সবচেয়ে প্রকট।
কয়েক বছর থেকে ভাঙ্গণের কবলে পড়ে শত শত একর জমি বিলীন হয়েছে। হাজারো পরিবার বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব।
অন্যদিকে সুরমা-কুশিয়ারা দুটি নদীরই সিলেট অংশেও ভাঙন রয়েছে। ভাঙনপ্রবণ গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের মাঝে বিরাজ করছে আতঙ্ক ।
অনেক এলাকার বাসিন্দারা ভাঙন রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
সরজমিনে দেখা গেছে, সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের দর্শা, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হেরাখলা এবং মোগলগাঁও ইউনিয়নের যোগীরগাঁওয়ে ভাঙন বেশি।
এছাড়া পশ্চিমদর্শা গ্রামের প্রায় ৩০০ পরিবার সুরমা নদীর পাড়ে বসবাস করছে। যারা প্রতিনিয়ত নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকেন।
তাদের মধ্যে কয়েকটি পরিবারের বাড়ির কিছু অংশ এরই মধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া মোগলগাঁও ইউনিয়নের লালারগাঁও, তালুকপাড়া, খালপাড়, মিরেরগাঁও, ফতেহপুর, ফুলকুচি, পিরেরগাঁও, আকিলপুর ও নোয়াগাঁওয়ের একাংশে ভাঙন রয়েছে।
কান্দিগাও ইউনিয়নের দর্শা গ্রামের বাসিন্দা রহমান ফারুক বলেন, এই এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে ভাঙন থাকায় অনেকেই গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। স্বজনরা একে অন্যের থেকে স্থানান্থরিত হতে বাধ্য হচ্ছেন।
গ্রামের যে অংশটি বিদ্যমান, নদীর পানি নেমে যাওয়ার পর প্রতি বছরই ভাঙন দেখা দেয়। তিনি জানান, এলাকাবাসী মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন-ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
কান্দিগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মনাফ জানান, তার ইউনিয়নের বেশকিছু গ্রাম সুরমা নদীর তীরবর্তী। পশ্চিমদর্শা, হেরাখলা ছাড়াও ধনপুর, জাঙ্গাইল এলাকায় নদীভাঙন আগ থেকেই ছিল।
প্রতিবছর বর্ষায় পানির স্তর নেমে আসার সাথে ভাঙন দেখা দেয়। তিনি বলেন, গ্রামগুলো রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে, আন্তঃসীমার নদী দুটির জকিগঞ্জ অংশে ভাঙন আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। হাটবাজার, ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলি জমি, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গেছে সুরমা ও কুশিয়ারায়। পুরো জকিগঞ্জ উপজেলার অর্ধশতাধিক স্থানে দেখা দিয়েছে ভাঙন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বর্ষা শেষে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। উপজেলার কেছরী, মাইজকান্দি, জকিগঞ্জ বাজার, নরসিংহপুর, সুনাপুর, বেউর, মানিকপুর, ভাখরশালসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব গ্রামের কোথাও কোথাও ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে।
জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আব্দুল মুকিত বলেন, কুশিয়ারা নদীর বাঁক এখন ছবড়িয়া গ্রামের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। ছবড়িয়া গ্রামের সৈয়দ আমিরুল ইসলাম মাদানী আল হুসাইনি (র.) এর মাজার নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভাঙন রোধের উদ্যোগ না নিলে তীরবর্তী অনেক গ্রামের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে। গ্রামের অনেকের ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বসতভিটা হারিয়ে তারা এখন অন্যের জায়গায় বসবাস করছে।
ভাঙন রোধে পদক্ষেপের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, বর্ষায় উজান থেকে আসা নেমে পানির চাপে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আবার শীত মৌসুমে ভাঙন দেখা দেয়। প্রকৃত অর্থে জকিগঞ্জের পরিস্থিতি ভালো নয়। আমরা ভাঙন রোধের চেষ্টা করছি। সার্বিক পরিস্থিতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ অংশেও ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জ-মানিককোনা-গোলাপগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ফেঞ্চুগঞ্জ অংশের গঙ্গাপুর নামক স্থানটিতে ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভাঙন শুরু হলে সড়ক বিভাগ সংস্কার কাজ করছে। তবে কুশিয়ারার ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর ভাঙন কবলিত স্থান উত্তর ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়ন। তীরবর্তী শত শত বাড়িঘর এরই মধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
উত্তর ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফজাল হোসাইন জানান, কুশিয়ারার ভাঙন আগ্রাসী হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ফেঞ্চুগঞ্জ-মানিককোনা-গোলাপগঞ্জ রক্ষা করা যাবে না। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বড় প্রকল্প হাতে নিতে হবে। ইউনিয়নের মানিককোনা, ভেলকোনা, সুলতানপুর, গঙ্গাপুর ও গয়াসী গ্রামের বাড়িঘর এবং ফসলি জমি প্রতি বছরই নদীতে বিলীন হচ্ছে।
সুরমা ও কুশিয়ারার ভাঙন রোধে পদক্ষেপ প্রসঙ্গে পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ভাঙন রোধে একটি সমীক্ষা হয়েছে। এর ফল হিসেবে তিনটি ধাপে প্রকল্প তৈরি করে ঢাকা পাঠিয়েছি।
প্রথম ধাপে ১ হাজার ৭০০ কোটি, দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ৫০০ কোটি ও শেষ ধাপে ৫০০ কোটি টাকার প্রস্তাবন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো পাস হলে নদীভাঙন আর থাকবে না বলে তার মন্তব্য।
নদীভাঙনের কারণ প্রসঙ্গে দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সেখানে নদী তীরবর্তী বাড়িতে অনেক পুকুর রয়েছে। যেগুলো ছিদ্র হয়ে ভাঙন দেখা দেয়। আমরা সব পুকুর ভরাট করে দিতে চাই। সিলেটের নদ-নদীতে একদিকে চর জাগলে; অন্যদিকে ভাঙন দেখা দেয়।
ভাঙন রোধে চরে ড্রেজিং করে সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে এলেই ভাঙন রোধ করা যাবে বলে তার মন্তব্য।