শব্দদূষণ চরমে, নাকাল নগরবাসী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ৪:৪৯:৪২ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম:
সামনে গাড়ি নেই তবু বাজছে হর্ন। অবিরাম বেজেই চলছে। কারণে-অকারণে এভাবেই চলার পথে হর্ন বাজানোর আস্ফালন। যে হর্ন-শব্দ শুধু কানে নয়, বুকের মধ্যেও আঘাত করে। এ যেন গাড়ির হর্ন নয়- মনের অসুখ’ কথাগুলো বলছিলেন রুহেনা খানম নামে একজন অভিভাবক।
অগ্রগামী স্কুল এন্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে তাঁর সন্তান পড়ছে। অগ্রগামীর পাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ওই স্কুলের আরেক অভিভাবক আফসানা শিকদারও বলেছেন হর্ন নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। বলেছেন, ‘হর্ন দেয়া চালকদের বদ অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। জিন্দাবাজার এলাকায় সন্তানদের নিয়ে চলাফেরা দিন দিন আরো কঠিন হচ্ছে।
যখন গাড়ির জ্যাম লাগে, তখন হর্নও বেড়ে যায়। একদিকে, থাকে তাড়াহুড়ো, জ্যাম থেকে মুক্তি পাবার ; অন্যদিকে, এমনভাবে হর্ন বাজানো হয়- যেন জ্যাম না ছুটলেও গাড়িগুলো উড়াল দিয়ে চলে যাবে।
রুহেনা খানম কিংবা আফসানা শিকদার চলার পথে প্রতিদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেও এই সমস্যাগুলো প্রকৃতপক্ষে সব মানুষের, যারা প্রতিদিন ঘর থেকে বের হন, যারা যখন-তখন ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে দীর্ঘ সময় পার করেন।
এদিকে, বিশিষ্ট চিকিৎসক সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক কান গলা ও হেড- নেক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. নূরুল হুদা নাঈম বলেন, ‘শব্দের মাত্রা থাকবে সর্বোচ্চ ৬০ ডেসিবেল। এই মাত্রায় হর্ন থাকলে মানুষ শব্দটা ভালোভাবে শুনতে পায়।
কিন্তু ৮০ ডেসিবেলের উপরে গেলে কানে মারাত্মক সমস্যা হবে। কিন্তু, রাস্তাঘাটে অনেক সময় ১১০ ডেসিবেলের উপর দিয়ে শব্দের মাত্রা প্রবাহিত হয়। এই মাত্রায় নিয়মিত হর্ন হলে একজন মানুষের শোনার ক্ষমতা ডেমেজ (ক্ষতিগ্রস্ত) হয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘উঠতি বয়েসি ছেলেরা মোটর সাইকেলে এক ধরনের বিকট আওয়াজের সাইলেন্সার ব্যবহার করেন। এটি বড়দের পাশাপাশি শিশুদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে।
এদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা দরকার। এজন্য দরকার ট্রাফিক পুলিশের বিশেষ নজরদারী। নইলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
সিলেট নগরীতে যত্রতত্র হর্ন-প্রতিদিনের চিত্র। তার মধ্যে রয়েছে হাইড্রোলিক হর্নের যন্ত্রণা। জ্যাম না থাকলেও কিছু চালক অপ্রয়োজনে হর্ন বাজাতে অভ্যস্ত। তারা নিরিবিলি ফাঁকা সড়কেও হর্ন দিয়ে চলাফেরা করেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. তায়েফ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘শব্দদূষণের কবলে পড়ে ঘরে ঘরে শিশুরা কানের সমস্যায় ভুগছে। তারা খিটখিটে স্বভাবের হচ্ছে। অল্পকিছুতেই রাগান্বিত হয়ে যায়। এই সমস্যাগুলো ভবিষ্যতে তাদের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
২০০৬ সালের শব্দদ‚ষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা থাকবে ৫০ ডেসিবেল এবং রাতের বেলায় ৪০ ডেসিবেল।
অথচ সিলেট নগরীর ভেতর ব্যস্ততম সড়কগুলোতে দিনের বেলাতেই ৮০ থেকে শতাধিক মাত্রায় শব্দ হচ্ছে। কিন্তু মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের সম্মুখেই এগুলো হচ্ছে। তবে সিলেটের ডিসি (ট্রাফিক) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলছেন, অন্যকথা।
যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শব্দদূষণ বন্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান রেখেছি। ২০২৪ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু হাইড্রোলিক হর্ন আমরা খুলে নিয়েছি। দু’একদিনের মধ্যে আবার সেই অভিযান শুরু করবো।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করে পরিবেশবাদী সংগঠন ভ‚মিসন্তান। সংগঠনের মুখপাত্র আশরাফুল কবীর বলেন, ‘শব্দদূষণের ব্যাপারে চালকদের সচেতন করতে অনেক কিছু উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
কিন্তু পুলিশ কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শহরে একটি সাইনবোর্ড খুঁজেও পাওয়া যাবে না, যেখানে উচ্চশব্দের হর্নের ক্ষতিকারক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।’ তিনি বলেন, হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ করা, হর্ন বাজানোর শাস্তি বাড়ানো ও চালকদের শব্দ সচেতনতা যাচাই করে লাইসেন্স দেওয়ার পদক্ষেপ নেয়া। তবেই এটি স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বলেন, ‘শব্দদ‚ষণ আইন চ‚ড়ান্ত করার চেষ্টা চলছে। সেটি নিশ্চিত হলে আইনও কঠোর হতে পারবে। তবে সবার আগে দরকার জনসচেতনতা।’