সরাসরি সহায়তা করেন ৭ জন, ৩ নার্স সাময়িক বরখাস্ত
ওসমানী হাসপাতালে অনুপস্থিত থেকেও ১৬ নার্স তুলে নিলেন ১৮ লাখ টাকা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ৪:৩০:৫৬ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৬ জন নার্স কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও ১৮ লাখ টাকা অবৈধভাবে তুলে নিয়েছেন। হাসপাতালে কর্মরত ৭ নার্সের সহায়তায় তুলে নেয়া হয় এই অর্থ। এদের মধ্যে তৃষ্ণা তেরেজা ডি কস্তা, আছমা আক্তার খানম ও আসমা আক্তার নামের তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে নার্সিং অধিদপ্তর। শিগগিরই অন্যদেরও সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. ওমর রাশেদ মুনীর সিলেটের ডাককে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ১৬ জন নার্সিং কর্মকর্তা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও অর্থ উত্তোলন করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে ধরা পড়েছে। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বাকিদের বিরুদ্ধেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা। পুরো বিষয়টির তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে কিভাবে এমন ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছিল।
জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার সবচেয়ে বৃহৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকা নার্সদের ডিউটি রোস্টারে নাম রাখা, অনুপস্থিত থেকেও বিধিবহির্ভূতভাবে বেতন-ভাতা উত্তোলনের বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নজরে আসার পর তোলপাড় শুরু হয়। ৫ আগস্টের পরে বিষয়টির প্রাথমিক তদন্ত হলে ৪৩ জন নার্সের মধ্যে ১৬ জন অনুপস্থিত থেকেও ১৮ লাখ ৪ হাজার ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা অবৈধভাবে উত্তোলন করেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। গত ৮ জানুয়ারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আনোয়ার হোসেন আকন্দ ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের নিকট পত্র দিয়ে এই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদানের বিধিগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। বিষয়টি নিয়ে ওসমানী হাসপাতালে কানাঘুষা চললেও একটি চক্র ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠে। তবে, অধিদপ্তর থেকে আসা অর্থ ফেরত দেয়ার পত্রের পরই বিষয়টি নিয়ে ওসমানী হাসপাতালে তোলপাড় শুরু হয়। একই দিন পৃথক আদেশে ৩ নার্সকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওইদিন হাসপাতালের সেবা তত্ত¡াবধায়ককে দেয়া হয় কারণ দর্শানোর নোটিশ।
কে কত টাকা নিয়েছেন
নার্সিং অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, মো. ইউসুফ ২ মাসের ৬২ হাজার ১৪২ টাকা, মো. আব্দুর রহমান ১ মাসের ৬০ হাজার ৯৭ টাকা, লিপি রানী ১ মাসের ৩৬ হাজার ৬৭৯ টাকা, আওলাদ হোসেন মাসুম ঈদ বোনাসের ২১ হাজার ৪৬০ টাকা, জাহেদ আহমদের ১ মাসের বেতন ও দুটো বোনাসসহ ৪৩ হাজার ৪৫২ টাকা, এম এফ কে জান্নাত ২২ মাসের বেতন ও ৬টি বোনাসসহ ৭ লাখ ৯৫ হাজার ৯০৫ টাকা উত্তোলন করেন।
এছাড়াও একরামুল হক ১ মাসের ২৮ হাজার ৫০৭ টাকা , রুনা ১ মাসের ১৭ হাজার ৯২ টাকা , কামরুন নাহার ১২ মাসের বেতন ও বোনাসসহ ২ লাখ ৮২ হাজার ৫৩১ টাকা, ঝিলি ধর ২ মাস ২৪ দিনের ৪৯ হাজার ২৪৯ টাকা, মো. আলী আশরাফ ৪ মাস ও ২ বোনাসের ১ লাখ ৩২ হাজার ১৮৪ টাকা, মো. শাহিন মিয়া ৭ মাসের ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৬১ টাকা, শামীমা জান্নাত ৩ মাসের ৮৩ হাজার ২৭৭ টাকা, জান্নাতুল ফেরদৌসের ৬ দিনের ৫ হাজার ২১০ টাকা, মোছা. শিরিন সুলতানা ১ মাস ৯ দিনের ৭ হাজার ৮১৫ টাকা ও লাভলী বেগম দুটো বোনাসের ২০ হাজার ১৪০ টাকা উত্তোলন করেন।
কেবল ফেরত নয় দিতে হবে সুদও
উপরোক্ত ১৬ নার্সের মধ্যে কেউ কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার পরেও তাদের ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া এই সরকারি অর্থ উত্তোলন করে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ এমনও আছেন যে তারা কর্মস্থলে অনুপস্থিত এবং ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা হলেও তারা এই অর্থ তুলে নেননি। এদের প্রায় সকলেই বিদেশে অবস্থান করছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও অর্থ উত্তোলন করা অপরাধ। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমনকি কেবল অর্থ ফেরত দিয়েও রেহাই মিলবে না । ওই অর্থের সুদ পরিশোধ করারও বিধান রয়েছে।
৩ নার্স সাময়িক বরখাস্ত
১৬ নার্স কর্তৃক অর্থ উত্তোলনে সহায়তাকারী হিসেবে ওসমানী হাসপাতালে বর্তমানে কর্মরত ৭ জন নার্সের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে। এদের কেউ কেউ বিগত দিনে হাসপাতালের নার্সিং অঙ্গনে নেতৃত্বও দিয়েছেন। তবে, হাসপাতাল সূত্র ৭ নার্সের ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি নয়। এরই মধ্যে ৩ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করায় কেবল তাদের নাম জনসমক্ষে এসেছে। সাময়িক বরখাস্তকৃত নার্সরা হলেন, গাজীপুর জেলার টঙ্গী উপজেলার পাগড় গ্রামের রাফায়েল বিনয় ডি কস্তার কন্যা সিনিয়র স্টাফ নার্স তৃষ্ণা তেরেজা ডি কস্তা, কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার কৃষ্ণপুরের আইয়ূব খানের কন্যা মোসা. আছমা আক্তার খানম ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার কামারকাঠি গ্রামের আফসার আলীর কন্যা আসমা আক্তার। এছাড়াও অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে চরম অবহেলার প্রমাণ পাওয়ায় ওসমানী হাসপাতালের সেবা তত্ত¡াবধায়ক রিনা বেগমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সিনিয়র স্টাফ নার্স তৃষ্ণা তেরেজা ডি কস্তার সেলফোনে একধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। একইভাবে সিনিয়র স্টাফ নার্স আসমা আক্তার ও সেবা তত্ত¡াবধায়ক রিনা বেগমের সেলফোনে কল দেয়া হলেও তারা দু’জনও কল রিসিভ করেননি। অপর সিনিয়র স্টাফ নার্স আছমা আক্তার খানম কল রিসিভ করেন। অভিযুক্ত এই নার্সের দাবি তিনি এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নন। তিনি বলেন, আমি ওয়ার্ডে ডিউটি করি, হিসাব শাখায় কখনো ডিউটি করিনি। বেতন বিল করার জন্য আলাদা আইবাস সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয় এবং ডিডওশিপ উপ-পরিচালকদের মাধ্যমে ফরওয়ার্ড করা হয়। কেউ হয়তো আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।