লন্ডন প্রবাসীর বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত বুরজান ও ফুলতলা চা বাগানের অচলাবস্থা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা ও বৃটিশ হাইকমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ
সিলেটে চা খাতের সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মে ২০২৫, ৩:১০:৪৪ অপরাহ্ন

ডাক ডেস্ক ॥ সিলেটের চা খাতের সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। নিলাম ব্যবস্থার ফাঁদ, সিন্ডিকেটের দখলদারিত্ব,ভারতীয় সস্তা চায়ের আগ্রাসন, ঋণের অভাব ও সরকারের নীরবতায় সিলেটে একের পর এক চা বাগান বন্ধ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, প্রবাসী বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত সিলেটের বুরজান ও ফুলতলা চা বাগানের অচলাবস্থা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা ও বৃটিশ হাইকমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিনিয়োগকারীরা।
চা শিল্পের সাথে কয়েকটি সূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চা নিলাম ব্যবস্থাটি এখনো ব্রিটিশ আমলের পুরনো কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে। উৎপাদন হয় এক জায়গায়, আর নিলাম হয় আরেক জায়গায়। এই ব্যবস্থায় চা শিল্পের জন্য একধরনের ফাঁদ তৈরি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বাজারে সিন্ডিকেটের দখলদারিত্ব দিন দিন বাড়ছে, যা প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে। তৃতীয়ত, ভারতীয় সস্তা চায়ের আগ্রাসন দেশীয় শিল্পকে চরমভাবে চাপে ফেলেছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব সমস্যার মুখে সরকারের নীরবতা। ফলে আগ্রাসন ও সংকট ক্রমশ গভীর থেকে গভীর হচ্ছে।
নর্থ সিলেট ভ্যালি টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নোমান হায়দার চৌধুরী সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল আলোচনায় জানান, চা শিল্পের প্রধান সমস্যাগুলো বর্তমানে অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। একের পর এক বাগান বন্ধ হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা অনেকটা উৎকণ্ঠায়।
প্রধান উপদেষ্টা ও বৃটিশ হাই কমিশনের সহযোগিতা কামনা
এদিকে, সিলেটের বুরজান ও ফুলতলা চা বাগানের অচলাবস্থা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা ও বৃটিশ হাই কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
এ দুটি চা বাগানের পরিচালক যুক্তরাজ্য প্রবাসী রেবেকা রফিক টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের নিকট লেখা এক চিঠির উল্লেখ করেন, তার বাবা চেয়ারম্যান মুহম্মদ রফিক ও ভাই এমডি জামিল রফিক ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত। বাবা ও ভাইকে দেখাশোনার জন্য তিনি এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সফর করতে পারছেন না। এমনকি টি বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের সাথে তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে পারছেন না। এ কারণে সংকট আরো বেড়ে চলেছে। পরিচালক রেবেকা রফিক টি বোর্ডের কাছে আবেদন করেছেন, ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতা পেলেই তারা শ্রমিকদের মজুরি মিটিয়ে দেবেন-এই জন্যে পরিচালনা বোর্ডকে পর্যাপ্ত সময় দেয়ার জন্যে ও তিনি আবেদন করেছেন।
ফুলতলা ও বুরজান চা বাগান দুটির মালিক মোহাম্মদ রফিক লণ্ডন প্রবাসী। ৪০ বছর আগে তিনি বিদেশী মুদ্রা দিয়ে জেমস ফিনলের নিকট থেকে বুরজান,জাফলং ও ফুলতলা বাগান তিনটি ক্রয় করেছিলেন। গত ৪০ বছর ধরে তার নিজস্ব অর্থায়নে ফুলতলা ও বুরজানের উন্নয়ন তিনি করে যাচ্ছেন। মুহম্মদ রফিকের ছেলে পরিচালক জামিল রফিক ও মেয়ে পরিচালক রেবেকা রফিক ও বাগানের পরিচালনা বোর্ডে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের চা শিল্পের সমস্যা নতুন সমস্যা নয়, ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চা শিল্পের সমস্যা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু বিগত সরকার এ ব্যাপারে নজর না দেয়ায় বর্তমানে সিলেটের অর্ধ শতাধিক বাগান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই চা শিল্পের সমস্যা সমাধানের কোন সুদূর প্রসারি উদ্যোগ না থাকায় চা শিল্প মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে লন্ডন প্রবাসি মুহম্মদ রফিক বিনিয়োগকৃত বুরজান ও ফুলতলা চা বাগানের পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। বুরজান এবং ফুলতলা চা বাগানের অচলাবস্থা নিরসনে টি বোর্ড এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগের প্রশংসা করে তারা বলেন, এই সাময়িক ব্যবস্থা স্থায়ী কোন সমাধানের পথ নয়।
গত ৪ মে সিলেটের বুরজান, ছড়াগাঙ ও কালাগুলের চা শ্রমিকরা তাদের বকেয়া মজুরীর দাবিতে সিলেট এয়ারপোর্ট রোড অবরোধ করে। জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকরা ফিরে গেলে টি বোর্ড ও জেলা প্রশাসন অচলাবস্থা নিরসনের জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। টি বোর্ড ও জেলা প্রশাসন ফুলতলা চা বাগানের অচলাবস্থা নিরসনের জন্যে তাদের প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন। প্রশংসনীয় এই প্রক্রিয়ার সাথে মালিক পক্ষের প্রতিনিধিকে জড়িত রাখলে ভালো হত বলে চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। টি বোর্ড ও জেলা প্রশাসন বিষয়টি নজরে আনবেন বলে তাদের প্রত্যাশা।
চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্যে অবিলম্বে প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটির মাধ্যমে চা বাগানের সৃষ্ট সমস্যাসমূহ পূর্ণাঙ্গভাবে সমাধান করতে হবে। বিশেষ করে চা বাগানগুলোকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনতে হবে। কৃষিঋণ প্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতাও কমাতে হবে। চা নিলামে বর্তমানে যে সিন্ডিকেট রয়েছে তা ভাঙতে হবে। চা বাগানগুলো যাতে উপযুক্ত মূল্য পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। চা বাগানের সমস্যা সমাধানে টি বোর্ড, মালিকপক্ষ ও প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে। তা না করে লিজ বাতিল করার মত আত্নঘাতী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিলে সিলেটের চা শিল্প একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে সংশ্লিষ্টরা জানান, বুরজান, ফুলতলা, মালনীছড়া, দলই, রাজনগরসহ বড় বড় চা বাগানগুলো লন্ডনপ্রবাসীদের বিনিয়োগে ক্রয় করা হয়েছে এবং বিগত ৪০ বছর ধরে মালিকরা অর্জিত অর্থ বিদেশে না নিয়ে দেশেই বিনিয়োগ করেছেন। এই দু:সময়ে চা শিল্পকে রক্ষা করার জন্যে বৃটিশ হাইকমিশন ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড: মুহম্মদ ইউনুসের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। কোন কারণে এই শিল্প ধ্বংসের মুখে পতিত হলে নতুন প্রজন্মের প্রবাসী ব্যবসায়ীরা দেশে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বিষয়টির দিকে নজর রেখে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, টি বোর্ড ও জেলা প্রশাসনকে যৌথ ভাবে মালিক পক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে চা শিল্পবান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে প্রবাসী ব্যবসায়ীরা অনুরোধ জানিয়েছেন।