নগরীতে ফুটপাত দখলের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুন ২০২৫, ৬:৪১:২৬ অপরাহ্ন

আহমাদ সেলিম :
সিলেট নগরজুড়ে ফুটপাত দখল করার অবশিষ্ট আর কোনো জায়গা বাকি থাকলো না। সর্বশেষ বইয়ের বড় বাজার হিসেবে পরিচিত জিন্দাবাজার রাজাম্যানশনের প্রবেশপথটিও গিলে ফেলা হয়েছে। দখলের ষোলকলা পূর্ণ হয়ে পড়ায় নগরজুড়ে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে নগরবাসীর দুর্ভোগ ঠেকেছে তলানীতে। এ অবস্থায় সিটি কর্পোরেশন বলছে, উচ্ছেদ অভিযান আরো জোরদার করা হবে।
জুলাইয়ের পর প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা হয়েছে। সেই সভার টেবিলে ফুটপাতের বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখেননি নগরবাসী। সিলেট নগরজুড়ে সড়ক ও ফুটপাত হকারদের দখলে তো আছেই, তার মধ্যে নেই শৃঙ্খলার বালাই। যার যেখানে ইচ্ছে, সেখানই দখল করে নিচ্ছে। অবস্থা এমন-শুধু ফুটপাতের কারণে প্রবাসী অধ্যুষিত অনুপম সুন্দর শহরটি জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। তবে যত সময় যাচ্ছে, ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে দখলদার চক্রটি। ফুটপাত দখলের মধ্য দিয়ে নগরবাসীর চলাচলের অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছে-এমনটা বলছেন সচেতনমহল।
জুলাই বিপ্লবের পর থেকে সড়ক ও ফুটপাত জঞ্জালমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল সিলেট সিটি কর্পোরেশন। সেই ঘোষণাও নিরাশ করেছে নগরবাসীকে। এতে করে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভের শেষ নেই। উল্টো দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। হকারদের পসরা ফুটপাত ছাড়িয়ে সড়ক দখল করে নিয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় রাস্তার উপর চলছে বেচাকেনা। এতে করে নগরীর ব্যস্ততম কোর্ট পয়েন্ট, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার মোড় ও পয়েন্টে তীব্র যানজট হচ্ছে। সেই যানজট মানুষের দুর্ভোগকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘চরম একটা নৈরাজ্যের মধ্যে আমরা আছি। যাদের হাতে দায়িত্ব, তারাই তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না।’
এদিকে, ফুটপাত ও রাস্তা দখলমুক্ত করার দাবিতে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক, জেলা প্রশাসক ও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে সিলেট কল্যাণ সংস্থা, সিলেট বিভাগ যুব কল্যাণ সংস্থা ও সিলেট প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা। রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় সংস্থাগুলোর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোহাম্মদ এহছানুল হক তাহেরের নেতৃত্বে এই স্মারকলিপি দেয়া হয়। স্মারকলিপির মাধ্যমে তারা কঠোর কর্মসূচিরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, জুলাই বিপ্লবের পর নতুন একটি চক্র পুরো নগরজুড়ে যেন ফুটপাতের বড় একটি জাল বিছিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন সড়ক, ফুটপাত তারা দখল করে নিচ্ছে, তাদের ইচ্ছেমতো। বর্তমানে বৃহৎ বন্দরবাজার কিংবা জিন্দাবাজারে এমন একটা স্থান পাওয়া যাবেনা- যেখানে ফুটপাতে বিশৃঙ্খলা নেই। খোদ জেলা প্রশাসকের কার্যলায়ের মূল ফটকের প্রাঙ্গণ, পুলিশ সুপারের ফটক, সিটি কর্পোরেশন ফটক, স্টেশন ক্লাব ফটক, বাংলাদেশ ব্যাংক ফটক, সার্কিট হাউস ফটক-সব জায়গাতেই ফুটপাত দখলের দৌরাত্ম্য। সন্ধ্যার পর এসকল এলাকা দিয়ে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়ে। বাদ যায়নি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল ফটকগুলোও।
ফুটপাত দখলমুক্ত করার দাবিতে ঈদের পরে বৃহৎ কর্মসূচির কথা জানিয়েছেন নগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি সিলেট জেলা শাখার সদস্য সচিব আব্দুর রহমান রিপন। তিনি বলেছেন, সব সময় বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি, আইন শৃঙ্খলার সভায়ও বলেছি। এখন বাকি রাস্তায় নামা।
সিলেটের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ অগ্রগামি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, সরকারি কিন্ডার গার্টেন প্রাথমিক বিদ্যালয় ফটক, সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, রাজা জি.সি স্কুল, দুর্গাকুমার পাঠশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফটক ও ফুটপাতের দখলে নিয়ে নিচ্ছে। শহরের বইয়ের বড়বাজার হিসেবে পরিচিত রাজা ম্যানশন প্রাঙ্গণও গিলে ফেলেছে ফুটপাত। অগ্রগামী স্কুল এন্ড কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, অবস্থা দেখে মনে হয় সুযোগ পেলে ফুটপাত বিদ্যালয়ের ভেতরে নিয়ে আসবে। একইভাবে দুর্গাকুমার স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের কাছে (ফুটপাত) আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি।
এদিকে, ফুটপাত যতই সম্প্রসারিত হচ্ছে, ততই বাড়ছে যানজট। এই যানজট স্থায়ীরূপ নেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সড়ক আর ফুটপাতের জঞ্জাল। এ সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
প্রতিবছর ফুটপাত দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কখনো বাস্তবায়ন করা যায় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর নেপথ্যে কারণ ফুটপাতকে ঘিরে বিশাল বাণিজ্য। আর এই বাণিজ্য ধরে রাখতে নেয়া হয় রাজনৈতিক মদদ। রাজনৈতিক দলের নামদারি লোক, পুলিশ সবাই নিয়মিত চাঁদা নেয় হকারদের কাছ থেকে।
সাথে রয়েছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং। কোর্টপয়েন্টে সিএনজি অটোরিকসা স্ট্যান্ডটিও ভাগাড়ে পরিণত হয়ে গেছে। পুরো সড়কের চার-তৃতীয়াংশই তাদের দখলে। ফলে যানবাহন চলাচলের জন্য যেটুকু সড়ক অবশিষ্ট আছে, তাতে স্বাভাবিক যানচলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, বেশ কিছুদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় সিলেটের ক্বীনব্রীজ দিয়ে ভারী যানবাহান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে সেই ক্বীনব্রীজের উপরও হাট বসে গেছে। মোটকথা, পুরো নগরী এখন ফুটপাতের নগরী বললে ভুল হবে না।
সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার এর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা হলে তিনিও অভিযান অব্যাহত রাখা এবং আরো জোরদার করার কথা বলেছেন। সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ এর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন গ্রহণ করেননি।