কর্মবীর ওসমানী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:২৮:০৯ অপরাহ্ন
কামাল আহমদ
বঙ্গবীর ওসমানীর জন্ম ১ সেপ্টেম্বর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে। পৈত্রিক নিবাস সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার বর্তমান ওসমানীনগর থানার দয়ামীর গ্রামে। দয়ামীরের খান বাহাদুর মফিজুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র আতাউল গণি, তার ডাক নাম ছিল “আতা”। তাঁর কল্যাণময়ী মায়ের নাম ছিল জোবেদা খাতুন। পূর্বপুরুষ হযরত শাহজালালাল (র:)র ৩৬০ সঙ্গীর অন্যতম শাহ নিজাম উদ্দিন ওসমানী (র:)। আমরা দেখতে পাই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে শিক্ষা জীবন, সৈনিক জীবন, রাজনৈতিক জীবনের সর্বত্রই তিনি ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারী ছিলেন। বঙ্গবীর ওসমানীরা ছিলেন দু ভাই ও এক বোন, তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। বড় ভাই নূরুল গণিকে পিতার মতো শ্রদ্ধা করতেন। মাত্র ৫ বছর বয়সে ১৯২৩ খ্রি: ওসমানীর শিক্ষা জীবন শুরু করেন। তারপর ১৯২৯ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি আসামের শিলং কটনস স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ১৯৩২ সালে মায়ের আদেশে ভর্তি হন সিলেট সরকারী হাইস্কুলে। ১৯৩৪ সনে তিনি কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। এ কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য “প্রিটোরিয়া” পুরস্কার লাভ করেন। এ বছরই মহীয়সী মা জোবেদা খাতুন ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যে পারদর্শী ছিলেন বলে তার প্রেরণায় ওসমানী আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৬ সালে আইএ ১৯৩৮ এ বিএ এবং ১৯৩৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলে এমএ ১ম বর্ষে পড়ার সময়ই বৃটিশ ভারতীয় সেনা বাহিনীতে ১ম যোগদান করেন। এখানে প্রাসঙ্গিক কথা যে, আলীগড়েই ওসমানী নেতৃত্বের শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউওটিসির সার্জেন্ট, স্যার সৈয়দ হলের অন্যতম ছাত্র উপদেষ্টা। আসাম বেঙ্গল ছাত্র সংঘের সহ-সভাপতি পদে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ সনে লক্ষ্মৌর সার্ভেন্টস অব ইন্ডিয়া হলে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত ছাত্র সম্মেলনের বিষয় নির্বাচন উপ কমিটির সদস্য। এই ঐতিহাসিক সম্মেলন উদ্বোধন করেন প-িত জওহরলাল নেহেরু এবং সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এখানে উল্লেখ্য যে, আলী গড়ে অধ্যায়নকালে ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এমতাবস্থায় ওসমানী এমএ শেষ বর্ষের পরিক্ষা না দিয়েই ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগদান না করে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সেখান থেকেই মূলত এই অধম্য মানুষটির যাত্রা হলো শুরু তার সৈনিক জীবনের।
১৯৩৯ সনের জুলাই মাসে ওসমানী বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪০ সনের ৫ অক্টোবর তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারী একাডেমী থেকে সামরিক শিক্ষা লাভ করে বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারী একাডেমী থেকে সামরিক শিক্ষা লাভ করে বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যেই বৃটিশ সামরিক বাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ মেজর নিযুক্ত হন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ওসমানী একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। ১৯৪৬ সালে বৃটিশ বাহিনীর ইষ্টার্ন কমান্ড সিলেকশন কমিটি কর্তৃক উচ্চ শিক্ষায় দীর্ঘ মেয়াদের অধ্যায়নের জন্য যোগ্য বিবেচিত হলে মনোনিত হন। ১৯৪৭ সালে স্টাফ কলেজ প্রতিযোগিতামূলক পরিক্ষায় বৃটিশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে সবেচেয় বেশি নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি আইসিএস এ কোয়ালিফাইড হওয়ায় ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্য ১৯৪৬ সালে মনোনীত হন। কিন্তু তৎসময় সৈনিক জীবন ত্যাগ করতে তিনি অস্বীকার করেন। ১৯৪৭ সালে ওসমানী লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি কোয়ার্টার স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারীতে ওসমানী সেনাবাহিনীর তদানীন্তন চিফ অব দি জেনারেল স্টাফ, মেজর জেনারেল রেজিম্যান্টহার্টনের জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড-১ নিযুক্ত হন।
১৯৫১ সালে ওসমানী পাঞ্জাব সীমান্তে সংখ্যা গুরু ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচ- প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। শত শত কৃতিত্বের মাঝেও এই চৌকশ সৈনিক ওসমানী নিরবচ্ছিন্নভাবে চট্টগ্রাম সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করেন। ওসমানী ঐ মানুষ ছিলেন যিনি অবিভক্ত ভারতের সেনাবাহিনীতে বাঙালি রেজিম্যান্ট গঠনের প্রবক্তা। যার জন্য তাঁকে ঋধঃযবৎ ড়ভ ঃযব ইবহমধষ ৎবমরসবহঃ বলা হয়।
যে মানুষটি মনেপ্রাণে দেশ বিশ্ব মানবতার স্থান দিয়ে যে কয়দিন বেঁচেছিলেন, তা থেকে আমরা দেশ বিশ্ববাসী বলবো, তার হৃদয়ে ছিল, দেশ বিশ্বের মানবতা আমার। শান্তি শৃংখলার দেশ বিশ্ব আমার। শত্রু মুক্ত দেশ বিশ্ব আমার। পুরো বিশ্ববাসীর গণতন্ত্র আমার। আমৃত্যু গণতন্ত্রমনা ছিলেন ওসমানী। পাকবাহিনীর ভয় ছিল, ওসমানী তাদের কাছে ছিলেন “পাপা টাইগার” খ্যাত। বৃটিশ, পাক বাংলাদেশ, এ তিন দেশের শুধু নেপথ্যের নায়ক নন, বরং প্রত্যেক্ষ নায়ক তথা সফল বীর ছিলেন ওসমানী।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টর প্রধানসহ ঐ রণক্ষেত্রের শত শত কৌশলের নেপথ্যে প্রধান ছিলেন জেনারেল ওসমানী। মহান মুক্তিযুদ্ধ হয় মাত্র ৯ মাস। যার প্রতিটি মিনিটেই ওসমানী থাকবেন ইতিহাস। নিরস্ত্র ও অশিক্ষিত, লুঙ্গি গামছা পরা প্রশিক্ষণহীন মানুষগুলো নিয়ে। বিশ্বের চৌকষ পাঠান যুদ্ধাদের পরাভূত করে রণাঙ্গণে যে বিজয় ওসমানী নিয়ে আসলেন, সে জন্যে বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের পক্ষে আমৃত্যু স্যালুট।
লেখক: সাহিত্যকর্মী।