হিজড়া প্রসঙ্গে ইসলামের দিকনির্দেশনা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ৪:৩২:৩৫ অপরাহ্ন

মাওলানা মোহাম্মদ এহসান উদ্দিন
“তিনিই মহান সত্ত্বা, যিনি মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ৬)
“আকাশম-লী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন, অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা, তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।” (সূরা আশ-শূরা, আয়াত নং ৪৯)
“হে মুমিনগণ! তোমরা যারা ঈমান এনেছো! তারা কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠও হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা না করে তারাই যালিম।” (হুজুরাত-১১)
মহান আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে মানব জাতি আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনিই। আল্লাহ তায়ালার এ সৃষ্টিজগত বড় ব্যাপক ও বিস্তৃত এবং বৈচিত্রে ভরপুর। মহান আল্লাহ এ জগতকে তাঁর কুদরতি হাতের সুনিপুন ছোঁয়ায় নানাবর্ণে ও বৈচিত্রে সাজিয়েছেন। এ জগতের প্রতি তাঁর দয়া মায়া ও করুণা এবং অনুগ্রহের অন্ত নেই। বিস্ময়কর তাঁর এ সকল সৃষ্টির রহস্য। সৃষ্টির সেরা মানব সন্তান হিসেবে সমাজে আর দশজনের মত সম্মানের সাথে বসবাস, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুবিধাপ্রাপ্তি, সামাজিক, অর্থনৈতিক তথা রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও নিযুক্তির অধিকার রয়েছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে হিজড়াদের বিষয়ে নিরব থাকেনি বরং অত্যন্ত সুন্দরভাবে এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যামূলক দিক নির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রেও সবিস্তারে হিজড়াদের সামগ্রীক অধিকার প্রসঙ্গে খোলামেলা আলোচনা রয়েছে। নিচের আলোচনায় হিজড়াদের অধিকার প্রসঙ্গে কোরআন-হাদীস, ইসলামী আইন শাস্ত্র এবং পাশাপাশি প্রচলিত আইনে এ বিষয়ে কি কি দিক নির্দেশনা রয়েছে তা তুলে ধরা হলো।
হিজড়ার পরিচয় :
আরবি অভিধানে ‘খুনসা’, ইংরেজিতে ট্রান্সজেন্ডার, হার্মাফ্রোডাইট, হিব্রু ভাষায় ইউনাথ, বাংলায় হিজড়া, খোঁজা, শিখন্ডী, বৃহন্নলা, উভয়লিঙ্গ ইত্যাদি বলা হয়। হিজড়া হলো বিশেষ লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষ যারা না পুরুষ না নারী।
ইসলামী শরীয়াতে হিজড়া বিষয়ে বলা হয়েছে, যার পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ উভয়টি বিদ্যমান অথবা কোনোটিই নেই শুধু প্রশ্রাবের জন্য একটি ছিদ্রপথ রয়েছে। একই দেহে স্ত্রী এবং পুংচিহ্ন যুক্ত অথবা উভয় চিহ্ন যুক্ত মানুষই হলো হিজড়া (কামুসুল ফিকহ ৩/৩৭৭)।
মৌলিকভাবে ইসলাম মানুষকে পুরুষ ও নারী হিসেবে গণ্য করে থাকে। যে উভলিঙ্গের অধিকারী ব্যক্তির মাঝে, নারী বা পুরুষ, যে বৈশিষ্ট্য বেশি থাকবে, তিনি সেই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হবেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে হজরত আলী (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রসূত বাচ্চা পুরুষ-নারী নির্ধারণ করতে না পারলে তার বিধান কী জিজ্ঞাসা করলেন।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জবাব দিলেন, সে মিরাস বা সম্পদের উত্তরাধিকার পাবে যেভাবে সে প্রশ্রাব করে। এ হাদীসে স্পষ্ট যে, পুরুষপ্রবণ হিজড়াদের জন্য স্বাভাবিক পুরুষদের বিধান প্রযোজ্য হবে। নারীপ্রবণ হিজড়াদের জন্য সুস্থ নারীদের বিধান প্রযোজ্য হবে। আর দুইয়ের মাঝামাঝি হিজড়াদের জন্য স্বাভাবিক নারীদের বিধান প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ হিজড়াদের নারী-পুরুষ যে কোনো একটি শ্রেণিতে গন্য করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ ব্যাপারে একটি মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেটা হলো, দেখতে হবে হিজড়ার প্রশ্রাব করার অঙ্গটি কেমন? সে কি পুরুষদের গোপনাঙ্গ দিয়ে প্রশ্রাব করে? নাকি নারীদের মত গোপনাঙ্গ দিয়ে প্রসাব করে? গোপনাঙ্গ যাদের মতো হবে হুকুম তাদের মতোই হবে। অর্থাৎ গোপনাঙ্গ যদি পুরুষালী হয়, তাহলে পুরুষ। আর যদি নারীর মতো হয়, তাহলে সে নারী। আর যদি কোনোটিই বোঝা না যায়, তাহলে তাকে নারী হিসেবে গণ্য করা হবে। সে হিসেবেই তার উপর শরিয়তের বিধান আরোপ করা হবে। এ হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যার যৌনাঙ্গ যেমন সে তেমন মিরাস পাবে। মূত্র যে লিঙ্গ দিয়ে বের হবে সে সেই লিঙ্গের মানুষ। যদি মূত্র উভয় লিঙ্গ দিয়েই বের হয় তবে নিয়ম ভিন্ন। যদি মূত্র একসঙ্গে উভয় লিঙ্গ হতে বের হওয়া বন্ধ হয় তবে যেটা দিয়ে প্রথম বের হয়েছে সে ওই লিঙ্গভুক্ত হবে। যদি উভয় লিঙ্গ হতে একসঙ্গে বের হওয়া শুরু হয় তবে যেটাতে অধিক সময় ধরে মূত্র বের হবে সে ওই লিঙ্গভুক্ত। যদি না বোঝা যায় তবে সে উভলিঙ্গই থাকবে। বয়ঃসন্ধির সময় যদি তার বীর্যপাত নিয়মিত হয় তবে সে পুরুষ। আর ঋতুঃশ্রাব নিয়মিত হলে সে মেয়ে। যদি পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয় তবে তাকে নারী ধরা হবে আর যদি নারীর দিকে আকৃষ্ট হয় তবে পুরুষ ধরা হবে; কিন্তু উভয়ের দিকে আকর্ষণ বা কোনো আকর্ষণ না থাকলে সে উভলিঙ্গই থাকবে। কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য যেমন দাড়ি হওয়া, স্তন হওয়া ইত্যাদি লিঙ্গ নির্ধারণে সহায়ক হবে।
কোরআনের প্রাসঙ্গিক কতিপয় আয়াত :
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা সকল মানুষকেই তাঁর মর্যাদাবান সৃষ্টি হিসেবে সম্মানিত করেছেন। কোরআনে বলা হয়েছে:
এক.
“আর অবশ্যই আমরা আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, স্থলে ও সাগরে, তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; এবং তাদেরকে উত্তম জীবিকা দান করেছি আর আমরা যাদেরকে সৃষ্টি করেছি এবং অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি”। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত নং ৭০)
দুই.
“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের তাক্বওয়া অবলম্বন কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তাঁর থেকে তাঁর স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের দুজন থেকে বহু নর- নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন; আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর যাঁর নামে তোমরা একে অপরের কাছে নিজ নিজ হক দাবি কর, এবং তাক্বওয়া অবলম্বন কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারেও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক”। (সূরা আন-নিসা, আয়াত নং ১০)
তিন.
“আকাশম-লী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন, অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা, তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।” (সূরা আশ-শূরা, আয়াত নং ৪৯)
চার.
“আর এই যে, তিনি সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী; শুক্র বিন্দু হতে যখন তা স্খলিত হয়।” (সূরা-আন-নাজম, আয়াত নং ৪৪,৪৫)
পাঁচ.
“তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন, এবং এতে তাদের কোনো হাত নেই, আল্লাহ পবিত্র, মহান এবং তারা যাকে শরীক করে তা হতে তিনি উর্ধ্বে।” (সূরা-আল-কাসাস্, আয়াত নং ৬৮)
ছয়.
হতে সৃষ্টি করেন যুগল নর-নারী।” (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ,আয়াত নং ৩৯)
সাত.
অতঃপর তিনি তা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন হে মানুষ! আমি জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার।” (সূরা-আল-হুজরাত, আয়াত নং ১৩)
আট.
“তিনিই মহান সত্ত্বা, যিনি মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ৬)।
আল-হাদিসে হিজড়া প্রসঙ্গ :
হযরত আলী (রা:) রাসূল (সা:) কে জিজ্ঞেস করলেন, প্রসূত বাচ্চা পুরুষ নাকি নারী তা যখন জানা যায় না সেক্ষেত্রে তার বিধান কী? রাসূল (সা:) বললেন, সে মীরাস পাবে যেভাবে প্রশ্রাব করে সেভাবে। (সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং ১২৯৪, কানজুল উম্মাল ৩০৪০৩, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং ১৯২০৪)। রাসূল (সা:) এক আনসারী হিজড়ার নিকট আসলেন এবং বললেন, তাকে তোমরা মীরাস দিবে সে প্রথম যে রাস্তা দিয়ে প্রশ্রাব করে সে হিসেবে। (আলমুগনী ৬/২৫৩)
মনে রাখা দরকার, কেউই নিজ ইচ্ছায় পুরুষ, নারী বা হিজড়া হয় না। মহান আল্লাহ অশেষ কৃপা ও দয়ায় এবং একান্ত তাঁর নিজ ইচ্ছায় ও পছন্দে পুরুষ, নারী বা হিজড়া রূপে এ ধরাধামে সৃষ্টি করেছেন। এর পিছনে মহান আল্লাহর অপার কুদরতের রহস্য নিহিত রয়েছে। তিনি সকল বিষয়ে নিরঙ্কুশ ও একক ক্ষমতাবান; এর পিছনে আল্লাহ তায়ালার মহান হেকমত ও নিগূঢ় রহস্য বিরাজমান। হিজড়ারা পরিবার ও সমাজের হেলাফেলায় দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। এদের বেশিরভাগই কোনো না কোনো মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে।
কিন্তু মুসলিম পরিবারের এ সন্তানরা যখন আপনজনদের নিকট অবহেলা ও অভিশাপের পাত্র হয়, সমাজে কোথাও এদের ঠাঁই মেলে না, এমনকি সমাজের ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ; আলেম-উলামা, মসজিদের ইমাম-খতিব, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক কেউ তাদের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয় না বা মুখ খোলে না, তখন পরিবারের এই শিশুটির আশ্রয় কেবল হিজড়াদের কোনো না কোনো দলেই হয়ে থাকে। প্রতিটি মানুষের জীবনে পিতা-মাতার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এই হিজড়াদের পিতা-মাতা থেকেও নেই; যে কারণে ওদের একজন গুরু-মায়ের প্রয়োজন পড়ে। হিজড়াদের গুরু ওদের পিতা বা মাতার মত এবং গুরুকেই নিজেদের অভিভাবক এবং ধর্মাবতার মনে করে। গুরুর বিশ্বাসই তাদের ধর্ম। নিজেদের সমাজে এরা নিজস্ব সমাজের আইন মেনে চলে। ওদের এলাকাভিত্তিক একজন গুরু মা-ই যেন ওদের পিতা-মাতা, অভিভাবক; সবকিছু। যত রোজগার সব জমা হয় ওই গুরু মায়ের কাছে। গুরু মা তার ইচ্ছামত সবার মাঝে বন্টন করে।
হিজড়া ও ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গী
সমগ্র মুসলিম সমাজ একটি দেহের সাথে তুলনীয় এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি দায়িত্ব এবং অধিকার বন্ধনে আবদ্ধ। এ কারণে একজনের সুখে সবাই যেমনি আনন্দিত হয়, ঠিক তেমনি একজনের দুঃখ বা ব্যথায় ব্যথিত হয়। আর এমনটিই রাসূল (সা:) বলেছেন, “তুমি মুমিনদেরকে পরস্পর দয়া- ভালোবাসা এবং সহানুভুতি প্রদর্শনে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। দেহের একটি অঙ্গ যখন রোগাক্রান্ত হয় তখন শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জেগে এবং জ্বরাক্রান্ত হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। ” (সহিহ মুসলিম: হা: নং ৫৬৬৫)
সুতরাং হিজড়া যদি মুসলিম সন্তান হয় তাহলে সে আর অন্য ছেলে বা মেয়ে তো অভিন্ন অঙ্গ। তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অপমান করা মানে নিজেকে অপমান করা। আর যদি অমুসলিম হয় তাহলেও মানুষ হিসেবে তার সম্মান রক্ষা করা বাকিদের দায়িত্ব। দয়া ও অনুগ্রহের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি তাকে আহ্বান করা আমাদের কর্তব্য। অপর এক হাদীসে এসেছে, হজরত আনাস (রা:), রাসূল (সা:) থেকে বর্ণনা করেন, “তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে অপরের জন্যও তা পছন্দ না করবে।” (সহিহ মুসলিম, হা: নং ১৮০)
বলা হয়েছে, “হে মুমিনগণ! তোমরা যারা ইমান এনেছো! তারা কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠও হতে পারে। তোমরা এক অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং এক অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা। গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা না করে তারাই যালিম।” (হুজুরাত-১১)
তাই যেকোনো মুসলমানকে গালি দেয়া যেমন অন্যায় এবং গুনাহর কাজ, ঠিক তেমনি হিজড়া মানুষকে গালি দেয়া বা মন্দ বলা এর চেয়ে বেশি গুনাহ। হিজড়াদের দূর্বলতার কারণে তাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার অর্থই হলো, আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, তাঁর সৃষ্টিকে হাসি তামাশার বিষয় বানানো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “যারা বিনা অপরাধে মুমিন নর-নারীকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ এবং পাপের বোঝা বহন করে।” (আহযাব-৫৮)
আমাদের সমাজে যারা বৈচিত্র্যময় লিঙ্গের অধিকারী তারা তো আমাদের কারো না কারো পরিবারের সদস্য। কারো ভাই-বোন, কারো সন্তান। তাই তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা এটা শুধু অনৈসলামিকই নয়: সম্পূর্ণ অমানবিকও বটে। পবিত্র হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, “এক ব্যক্তি রাসূল (সা:) এর নিকট এসে দাঁড়াল। উপস্থিত লোকেরা তার দাড়ানোর মাঝে দুর্বলতার ছাপ লক্ষ করে বলল: কিসে তাকে এমন করে দিয়েছে! তখন রাসূল (সা:) বললেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করেছ এবং তার গীবত করেছ।”
হিজড়া সন্তান এর প্রতি দয়া ও মমতা প্রদর্শন :
হিজড়া সন্তান বোঝা নয় সে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষ। তাদেরকে আদর সোহাগ ও যতœ দিয়ে সংসারে আগলে রাখতে হবে। পবিত্র হাদিসে দূর্বল মানুষদের প্রতি যতœশীল হওয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। হযরত সা’দ ইবনে উবাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, “রাসূল (সা:) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ আপন বান্দাদের মধ্য হতে দয়াশীল বান্দাদের প্রতি দয়া করেন।” (বোখারী, ৯/১৩৩, ৭৪৪৮)
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীসে নবী (সা.) বলেন, “দয়াশীল ব্যক্তিদের। প্রতি রাহমান (অতিশয় দয়ালু আল্লাহ) দয়া করেন। কাজেই তোমরা জমিনবাসীদের প্রতি দয়া কর, তাহলে আসমানবাসীও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।” স্পষ্ট যে, আল্লাহর দয়া পেতে চাইলে সকল সৃষ্টির প্রতি বিশেষত দুর্বল ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি বিশেষভাবে দয়া করা উচিত। অন্য হাদীসে এসেছে, বাংলাদেশে প্রচলিত প্রধান চারটি ধর্মে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, “রাসূল (সা:) বলেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ওই ব্যক্তি যে মানুষের সবচেয়ে কল্যাণকামী। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো কোনো মুসলিমের অন্তরকে খুশি করা; অথবা তার থেকে কোনো বিপদ দূর করা কিংবা তার ঋণ পরিশোধ করা বা ক্ষুধা নিবারণ করা। আমার ভাইয়ের প্রয়োজনে তার সাথে চলা আমার নিকট মসজিদে নববীতে এক মাস ইতিকাফ করার চাইতে উত্তম। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে পথে চলবে, এমনকি তার প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করবে, আল্লাহ সেদিন তাকে দৃঢ়পদ রাখবেন যেদিন মানুষের পা পিছলে যাবে।” (বোখারী, ১৩৬৪৬)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেছেন, আল্লাহ ওই জাতিকে পবিত্র করবেন না যাদের মধ্য হতে দুর্বল ব্যক্তি সবল ব্যক্তি থেকে তার প্রাপ্য অধিকার সহজে বুঝে পায় না।” (বোখারী, ১০/ ১৬০, ২০২০১)
উক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, সমাজে দুর্বল লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য অধিকার প্রদান করা গুনাহ মাফের মাধ্যম এবং ন্যায্য অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা লাঞ্ছনার কারণ।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন :
ফুকাহায়ে কেরাম তাদের রচনাবলীতে বাবুল খুনসা বা হিজড়াদের নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করেছেন। তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, হিজড়া তিন ধরনের হয়ে থাকে। (ক) কারো মধ্যে পুরুষ-লক্ষণ প্রবল (খ) কারো মধ্যে মেয়ে-লক্ষণ প্রবল এবং (গ) কারো মধ্যে উভয় লক্ষণই সমান। এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিকে পুরুষ এবং দ্বিতীয় শ্রেণিকে নারী গন্য করা হবে, আর তৃতীয় শ্রেণি হিজড়া। দীনের সাধারণ বিষয়গুলো এদের সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে, নারী- পুরুষ ভেদে যেসব বিধানে পার্থক্য আছে সেগুলো তারা উপরিউক্ত শ্রেণিভেদ অনুযায়ী পালন করবে।
ইসলাম হিজড়াদেরকে নারী ও পুরুষের মত গণ্য করতে আদেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হলো দেখতে হবে হিজড়া প্রগ্রাবের অঙ্গটি কেমন। সে কি পুরুষের গোপনাঙ্গ দিয়ে প্রশ্নাব করে না নারীর গোপনাঙ্গ দিয়ে প্রশ্রাব করে। গোপনাঙ্গ যার মতো হবে তার ওপর সেরকম হুকুম প্রয়োজ্য হবে। আর যদি কোনটিই বোঝা না যায় তাহলে তাকে নারী হিসেবেই গণ্য করা হবে। সেভাবেই শরীয়তের বিধান প্রযোজ্য হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো মৃত ব্যক্তি এক ছেলে, এক মেয়ে এবং এক হিজড়া সন্তান রেখে মারা যায়, তাহলে হিজড়াকে মেয়ের সমপরিমাণ অংশ দেয়া হবে। তদ্রুপ মৃত ব্যক্তি যদি এক ছেলে এবং এক হিজড়া রেখে মারা যায় তাহলে ছেলে পাবে দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ এবং হিজড়া সন্তান পাবে এক তৃতীয়াংশ সম্পদ। (ফতওয়ায়ে শামী ১০/৪৫০, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়্যাইতিয়্যাহ ২০/৩২, আররামী শরহে সিরাজী: পৃ:৯৪)
হিজড়াকে যদি কোনো পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হয় আর উক্ত পুরুষের জন্য তার সাথে সহবাস করা সম্ভব হয়, তাহলে উক্ত বিবাহ বহাল থাকবে। এমনিভাবে সে যদি কোনো নারীকে বিবাহ করে এবং সে নারীর সাথে সহবাস করতে সক্ষম হয় তাহলেও বিবাহ বহাল থাকবে। আর যদি সে সহবাসে সক্ষম না হয় এবং স্ত্রী আদালতের শরণাপন্ন হয়, তাহলে আদালত স্বামীকে এক বছর সময় দিবে। উক্ত সময়ের মধ্যেও যদি সে সহবাসে সক্ষম না হয় তাহলে আদালত তাদের মাঝে বিবাহ বিচ্ছেদ করে দিবে। (কিতাবুল আসল লি-ইমাম মুহাম্মদ ৯/৩২৩, আলমউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়্যাইতিয়্যাহ ২০/২৭) নারীসদৃশ হলে তারা নারীদের মতোই পর্দা বিধান মেনে চলবে। (আলবাহরুর রায়েক ৯/৩৩৬)
কোনো পুরুষের মাধ্যমে হোক বা নারীর মাধ্যমে, নাবালেগ অবস্থায়ই তাকে খতনা করিয়ে দিতে হবে। আর যদি সে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর খতনা করতে চায়, তাহলে খতনা করাতে পারে এমন কোনো নারীর সাথে তাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দিবে। নতুবা সে খতনা বিহীন জীবন যাপন করবে। (ফতওয়ায়ে শামী ১০/৪৪৮)
হিজড়াগণ হজ্বের সকল বিধি-বিধান নারীদের ন্যায় পালন করবে :
বাংলাদেশে প্রচলিত প্রধান চারটি ধর্মে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা। হিজড়া অভিজ্ঞ এবং মাহরাম কোনো পুরুষ ছাড়া তাদের হজ্ব করার অনুমতি নাই। (ফাতহুল কাদীর ১০/৫৫৩, আলবাহরুর রায়েক ৯/৩৩৬)
হিজড়াদের ইন্তিকালের পর কোনো নারী-পুরুষ তাদেরকে গোসল দিবে না; বরং তায়াম্মুম করিয়ে দিবে। এক্ষেত্রে যে তায়াম্মুম করাবে সে যদি হিজড়ার মাহরাম না হয় তাহলে হাতে কোনো কাপড় পেচিয়ে নিবে। কারণ পুরুষের জন্য কোনো নারীকে এবং নারীর জন্য কোনো পুরুষকে গোসল দেয়া শরীয়ত সম্মত নয়। একজন মুসলিম হিসাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জানাযার নামায পড়া হবে এবং তাকে নারীদের ন্যায় পাঁচ কাপড়ে কাফন পরানো হবে। কেননা সে যদি নারীদের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তো সুন্নাত সম্মত পন্থায় কাফন পরানো হলো। আর যদি পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই। কারণ পুরুষ তার জীবদ্দশায় তিনের অধিক কাপড়ও পরিধান করে। দাফনের সময় মাহরাম ব্যক্তিই তাকে কবরে নামাবে এবং চাদর ইত্যাদি দ্বারা তার কবরকে ঢেকে নিবে, এটা উত্তম এবং মুস্তাহাব। কেননা সে যদি প্রকৃতপক্ষে নারীর অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তো তা ওয়াজিবের পর্যায়ভুক্ত। (ফতওয়ায়ে শামী ১০/৪৫০, কামসূল ফিকহ ৩/৩৭৯)
সার্বিকভাবে হিজড়া সম্প্রদায়ের ন্যায্য এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় ও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং কল্যাণের জন্য গৃহীত কোনো কর্মসূচিই ইসলামবিরোধী হতে পারে না। কারণ পৃথিবীতে ধর্ম এসেছেই মানুষের কল্যাণের জন্য।
হিজড়াদের কল্যাণে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকবে পিতা-মাতা। হিজড়া সন্তান জন্ম নিলে পিতা- মাতা লজ্জাবোধ করে। পিতা-মাতাকে বুঝতে হবে এতে কোনো লজ্জার কারন নেই। বরং লজ্জাবোধ করা এক রকম জাহিলিয়াতের কাজ আর অজ্ঞতা। সমাজের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য হিজড়াদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা এবং তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করা। তাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য যথাযথ সুযোগ তৈরি করা। আইন ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিভিন্ন প্রশিক্ষণমুলক কর্মসূচি গ্রহণ করা। পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হওয়ার অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার এবং সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মতো সমান আইনি স্বীকৃতি নিশ্চিত করা। গৃহহীন হিজড়াদের জন্য নানা পর্যায়ে আবাসন প্রকল্প চালু করা, যেখানে স্বল্পমূল্যে বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন, সেবা-যতœ ও খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকবে। তাদের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা এবং নিজ পরিবারের সাথে সমাজে অন্য দশজনের মতো বসবাসের ব্যবস্থা করা।
সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে তাদের কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের এবং সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করা। তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন করা। কোনো ব্যক্তির প্রতি ইসলাম কোনো প্রকার বিরূপ মনোভাব পোষণ করে না। কাউকে সমাজের অপ্রয়োজনীয় উপাদান মনে করে না।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মানব মর্যাদার মানদ- কোনো বংশ, বর্ণ, গোত্র, ভাষা, সুস্থতা, সৌন্দর্য আর নারী-পুরুষের তারতম্যের ভিত্তিতে নিরূপণ করা হয় না। একমাত্র তাকওয়া এবং খোদাভীরুতাই এ মর্যাদার মাপকাঠি। তাই সমাজের প্রতিটি সচেতন নাগরিক বিশেষত হক্কানী আলেম-ওলামা, ছাত্র, মসজিদের ইমাম-খতীব, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো হিজড়াদের ব্যাপারে ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা। তাদের সকল অধিকার আদায়ের প্রতি জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। সর্বসাধারণের মাঝে হিজড়া সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সঠিক অবস্থান তুলে ধরা।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি সিলেট জেলা শাখা।