‘আইএস বধূ’কে থাকতে হবে সিরিয়াতেই
ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ফিরে পেলেন না বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১:১৯:০৩ অপরাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক : কথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গীগোষ্ঠীতে যোগ দিতে ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্য থেকে সিরিয়ায় পালিয়ে যাওয়া শামীমা বেগম ব্রিটেনে ফিরতে পারবেন না। শুক্রবার যুক্তরাজ্যের আদালত নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়া নিয়ে শামীমা বেগমের আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, তিনি আর ব্রিটেনের নাগরিক নন।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা যুক্তরাজ্যে। কিন্তু আট বছর আগে ব্রিটেন থেকে পালিয়ে সিরিয়ায় গিয়ে জঙ্গীগোষ্ঠি আইএসের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল ব্রিটিশ সরকার। সরকারের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গত বছরের অক্টোবরে লন্ডনের আপিল আদালতে মামলা করেন শামীমা।
শুক্রবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টার পর শামীমার আপিল মামলার রায় দেন ব্রিটিশ আদালত। রায়ে জানানো হয়, আইনগতভাবেই শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল ব্রিটিশ সরকার এবং বর্তমানে সিরিয়ায় বসবাসরত শামীমা বেগমের যুক্তরাজ্যে ফেরত আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই।
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, শামীমা বেগমের মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া কঠিন হলেও তিনি নিজেই তাঁর দুভার্গ্যের ভিত্তি রচনা করেছেন।
ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আদালতের এই রায়ের পর সন্তোষ প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘ব্রিটেনের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করাটাই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে অগ্রাধিকার। সেটি করতে গিয়ে আমরা যেকোনো ধরণের বড় সিদ্ধান্ত নেব।
কে এই শামীমা বেগম?
বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত শামীমা বেগম যখন যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে যান, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। তিনি একা যাননি। তাঁর সঙ্গে আরো গিয়েছিল তাঁর বন্ধু খাদিজা সুলতানা ও আমিরা আবাসি। খাদিজার বয়স ছিল ১৬ ও আমিরার ১৫ বছর। ধারণা করা হয়, খাদিজা মারা গেছেন।
কিন্তু আমিরার বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। শামীমার না-বাবা যুক্তরাজ্যে থাকার সুবাদে সেখানেই শামীমা জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নেই।
২০১৯ সালে সিরিয়ার একটি শরণার্থীশিবিরে শামীমাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পাওয়া যায়, যখন তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর। শামীমা একটি সন্তান জন্ম দিলেও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সেই শিশুটি মারা যায়। ওই সময় জাতীয় নিরাপত্তার কারণে ব্রিটিশ সরকার শামীমার নাগরিকত্ব কেড়ে নিলে শামীমা সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তিনি যুক্তরাজ্যে ফিরে যেতে চান বলেও জানান।
শামীমা বেগম তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে আইএসের নিয়ম-কানুন ও শাসনের অধীনে ছিলেন। শামীমা বেগম তুরস্ক হয়ে সিরিয়ার রাক্কায় পৌঁছনোর পর একজন ডাচ বংশোদ্ভূত আইএস যোদ্ধার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় এবং সেখানে তাঁর তিনটি সন্তান হয়, যাদের সবাই মারা গেছে।
শামীমা স্বীকার করেছিলেন, নিষিদ্ধ সংগঠন জেনেই তিনি আইএসে যোগ দিয়েছিলেন। পরে তিনি এ-ও বলেছিলেন, এই দলে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি লজ্জিত ও দুঃখিত।
‘আইএস বধূ’ হিসেবে সংবাদমাধ্যমে পরিচিত শামীমার বর্তমান বয়স ২৪ বছর এবং তিনি সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আল-রোজ নামক এক বন্দিশিবিরে বসবাস করছেন।
কিভাবে সিরিয়ায় গিয়েছিল?
ইসলামিক স্টেট জঙ্গীগোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগমকে কানাডার নিরাপত্তা সংস্থার এক গুপ্তচর সিরিয়ায় পাচার করেছিলেন। ২০২২ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এই গুপ্তচর শামীমা বেগমের পাসপোর্টের বিস্তারিত তথ্য কানাডাকে জানিয়েছিলেন এবং আরো ব্রিটিশ নাগরিককে ইসলামিক স্টেটের হয়ে লড়াই করার জন্য পাচার করেছেন।
২০২২ সালে বিবিসি’র ‘আই এম নট এ মনস্টার’-এ কথা বলেছেন শামীমা বেগম। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘মোহাম্মদ আল রশিদ তুরস্ক হতে সিরিয়া পর্যন্ত যাওয়ার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন..আমার মনে হয় না পাচারকারীদের সাহায্য ছাড়া কারো পক্ষে সিরিয়ায় যাওয়া সম্ভব ছিল। উনি আরো বহু মানুষকে আসতে সাহায্য করেন…তিনি আমাদের যা যা করতে বলেছিলেন, আমরা তাই করছিলাম। কারণ তিনি সব জানতেন, আমরা তো কিছু্ই জানতাম না।’
শামীমা বেগমকে পাচারে সাহায্য করার কিছু দিনের মধ্যেই মোহাম্মদ আল রশিদ তুরস্কের সানলিউরফা শহর থেকে গ্রেপ্তার হন। এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি শামীমা বেগমসহ যাদেরকে পাচারে সহযোগিতা করেন, তাদের সবার তথ্য তিনি সংগ্রহ করতেন। কারণ এসব তথ্য তিনি জর্দানে কানাডার দূতাবাসে পাঠাচ্ছিলেন।
বাংলাদেশে ফিরতে পারবে শামীমা?
ব্রিটিশ সরকার তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করার পর বিষয়টি নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল ২০১৯ সালে। কাউকে রাষ্ট্রবিহীন করা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ—সে সময় এমন বিতর্ক উঠলে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, শামীমা বেগম তার মা-বাব সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিতে পারেন।
কিন্তু ২০১৯ সালের মে মাসে লন্ডনে বিবিসি বাংলার স্টুডিওতে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, শামীমা বেগমকে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
আব্দুল মোমেন আরো বলেন, ‘শামীমা বেগমকে আমরা চিনি না। শামীমা বেগমের জন্ম ব্রিটেন। ব্রিটেনে বড় হয়েছে, শিক্ষা দীক্ষা ব্রিটেনে। সে কোনো দিন বাংলাদেশে যায়নি। কখনো বাংলাদেশের নাগরিকত্বও চায়নি…তার মা-বাবও ব্রিটিশ নাগরিক।’
মন্ত্রী বলেন, শামীমা বেগমের দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকারের এবং তাকে নিয়ে তারা কী করবে সেটা তাদেরই দায়িত্ব। ‘আমাদের এর সঙ্গে জড়ানো খুবই দু:খজনক।’
এর পরও যদি শামীমা বেগম বাংলাদেশে গিয়ে হাজির হয়, তাহলে সরকার কী করবে?—বিবিসির এই প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আইন অনুযায়ী শাস্তি দেব, জেলে নিয়ে যাব, সর্বোচ্চ শাস্তি হবে তার।’
কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত তো আদালতের?—এই প্রশ্নে মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশের আইনেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। আপনারাই (ব্রিটেন) বলছেন, সন্ত্রাসী। এ ধরনের সন্ত্রাসীদের কি এ দেশে আদালতে নেওয়া হয়? যুক্তরাষ্ট্রে তো তাদের সোজা গুয়ানতানামো বে বন্দি শিবিরে নেওয়া হয়। আর প্রথম কথা তাকে (শামীমাকে) বাংলাদেশে ঢুকতেই দেওয়া হবে না।’
সূত্র : বিবিসি