চল্লিশ বছর ধরে গ্রাম থেকে শহরে ঘুরছেন শাণওয়ালা উমেদ মিয়া
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০২৪, ২:৪৭:৪০ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম :
বাবার মৃত্যুর পর ছেলে উমেদ মিয়া কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শাণ মেশিন। তারপর জীবন থেকে বিয়োগ হয়ে গেলো চল্লিশটি বছর। এখনো শহর থেকে গ্রামে, পথে পথে শাণ মেশিন নিয়ে ঘুরেন, মানুষের কাচি, দা শাণ দেন। কিন্তু নিজের জীবনের চাকা এখনো ঠেলাগাড়ির মতো চলছে শাণহীন, থেমে থেমে।
কাঠ, চেইন আর গোলাকার একটি পাথর-এই হচ্ছে শাণ মেশিন। পাথরটি গ্রান্ডার নামে পরিচিত। শাণওয়ালাদের বিশেষ এ যন্ত্রটির মাধ্যমে কাচি, ভোঁতা ছুরি, বটি, লোহার যেকোন অস্ত্র ধার দেওয়া হয়। তাদের এই যন্ত্রে থাকে একটি পাথরের চাকতি। লোহার বস্তুটি চাকতির কার্নিশে ধরতেই আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে একধরনের শব্দ হয়। চাকতি ঘোরানোর জন্য পা দিয়ে প্যাডেল মারতে হয়। লোহা ও চাকতির ঘর্ষণে ভোঁতা যে কোনো অস্ত্র নতুন হয়ে উঠে । পায়ের প্যাডেল থামিয়ে একটু পর পর হাতের আঙুল দিয়ে চলে শাণ পরীক্ষার কাজ। অর্থাৎ এই কাজের সময় দুই হাত, দুই পা এবং চোখের বিশেষ মনোযোগ ধরে রাখতে হয়।
এই পেশায় একসময় ছিলেন উমেদ মিয়ার বাবা আজর আলী। এখন বাবা নেই, মা-ও নেই। সংসার চালাতে চল্লিশ বছর আগে শাণ মেশিন কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি, এখনো সেই পেশাতেই রয়ে গেছেন।
পয়ষট্টি বছরে চারপাশের কতকিছুর পরিবর্তন হয়েছে। উমেদ মিয়ার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বয়স পয়ষট্টি হলেও এই পেশার সাথে কেটে গেছে চল্লিশটি বছর। এখনো চশমা লাগেনি চোখে, ঠিকমতো কাজ করতে পারেন, সারা দিন পাড়ায় পাড়ায় পায়ে হেঁটে ঘুরতে পারেন ক্লান্তিহীন।
আকাশে ধূসর কালো মেঘের মিছিল। এই বুঝি বৃষ্টি হবে। মেঘময় এমন বিকেলে গতকাল শুক্রবার চলার পথে হঠাৎ দেখা হয় উমেদ মিয়ার সাথে, মির্জাজাঙ্গালস্থ হোটেল নির্ভানা ইন সড়কে। অনুমতি নিয়ে ছবি তুলি। নিজের মোবাইল নেই, অন্যের মোবাইল নম্বর দিয়েছেন যেকোনো প্রয়োজনে কথা বলার জন্য।
সংসারের বোঝা বড়ই ভারি উমেদ মিয়ার। একটি দা শাণ করতে শুরুর দিকে পারিশ্রমিক নিতেন পাঁচ টাকা। এখন নিতে হয় বিশ টাকা। টানাপোড়েনের সংসারে ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’-এমন অবস্থা। তাই নিজে সিলেটের একটি পাড়ায়, মেসে ভাড়া থাকলেও পরিবারকে রেখেছেন এশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্রাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বানিয়াচং গ্রামের পৈতৃক ভিটাতে।
সংসারে স্ত্রী, চার মেয়ে এবং তিন ছেলে উমেদ মিয়ার। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, আরো দুই মেয়ে এখনো সংসারে। ছেলেরা বয়সে এখনো শিশু। তারপরও এক ছেলে চায়ের রেস্তোরায় কাজ করছে।
যে সময় এই পেশা শুরু করেন উমেদ মিয়া, সে সময় চালের কেজি ছিলো হয়তো পনেরো থেকে বিশ টাকা। এখন চল্লিশ, পঞ্চাশ টাকার নিচে চাল পাওয়া কঠিন। একটু ভালো চলার আশায় কয়েক বছর আগে সিলেটে এসেছেন। এর আগে নিজের এলাকা, ঢাকাতেও এই কাজ করেছেন কয়েক বছর।
উমেদ মিয়া বলেন, ‘অনেক পেশায় মেশিন লেগেছে, এই পেশায় লাগেনি। তাই হয়তো এখনো কাজ করতে পারছি, এখনো সুস্থ আছি। প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি ঘুরি। দুইশো থেকে সর্বোচ্চ চারশো পর্যন্ত রুজি হয়। বলতে পারেন, কোনোরকম ধরে রেখেছি বাবার পেশা। এই টাকা দিয়ে নিজে খাই, বাড়িতেও খাওয়াই। তবে ঈদের সময় একটু ভালো রোজগার হয়। দিনশেষে হাজার, বারোশো পর্যন্ত পকেটে জমা হয়েছে।’
উমেদ মিয়া আরো বলেন, ‘শহরে এখন যেভাবে বড় বড় দালান বেড়েছে, গাড়ি বেড়েছে, একসময় তেমন ছিলোনা। আমাদের কন্ঠ খুব সহজে মা-বোনদের কানে পৌঁছে যেতো। এখন সারি সারি দালানের ভিড়ে উঁচুতলা পর্যন্ত পৌঁছায় না, আমাদের ‘শাণ দিবেন শাণ’ শব্দটি। সবার কাছে পৌঁছালে জীবনজুড়ে এতো অভাব থাকতো না।’
শাণওয়ালারা দা-বটি, কাঁচি, চাকু’র পাশাপাশি শীল পাটাও শাণ করেন। তবে আধুনিক প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় শহরের অধিকাংশ গৃহিণীদের কাছে এখন মসলা বাটার জন্য শীল-পাটার বদলে ব্লেন্ডার মেশিনের কদর বেড়েছে। তবে ব্লেন্ডারের তুলনায় পাটায় বাটা মসলা রান্নাকে বেশি সুস্বাদু করে-এমনটা মনে করেন এখনো প্রবীণরা।