মাসপূর্তি উপলক্ষে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টার কঠোর বার্তা
আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না, বিশৃঙ্খলা করলে শাস্তি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩:১২:২৮ অপরাহ্ন
ডাক ডেস্ক : দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। তার এই ভাষণ রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়।
গণতান্ত্রিক দেশের রূপরেখা বাস্তবায়নে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে সতর্ক করে বলেন, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।
বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন কোনো কাজ কেউ কোনোভাবেই করবেন না।
স্বৈরাচারমুক্ত দেশ গড়তে এবং গণতান্ত্রিক দেশের জন্য আইন মেনে চলার আহ্বান জানান ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, আপনাদের আমাদের সন্তানদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরি করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর যেন আমাদের কোন স্বৈরাচারের হাতে পড়তে না হয়, আমরা যাতে বলতে পারি আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করি, আমরা যাতে সবাই দাবি করতে পারি যে এই দেশটি আমাদের। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি।
৩৩ মিনিটের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সব অন্যায়ের প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, আমরা আমাদের দায়িত্বকালে যথাসম্ভব সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে এটি ড. ইউনূসের দ্বিতীয় ভাষণ। গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দেন তিনি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
একমাসে ১৯৮টি অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে
দায়িত্ব গ্রহণের একমাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ১৯৮টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘অতি স্বল্প জনবল নিয়ে দাফতরিক কার্যক্রম শুরু করা হলেও প্রথম দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে পাঠানো বিবিধ প্রস্তাব বিষয়ে দ্রুত গতিতে এবং আইনগত সব বাধ্যবাধকতা মেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত একমাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ১৯৮টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনপ্রশাসনের ১৩৫ জন অতিরিক্ত সচিব, ২২৭ জন যুগ্মসচিব ও ১২০ জন উপসচিবকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৫৯টি জেলার জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং নতুন ৫৯ জন জেলা প্রশাসককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৬৭ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ১০ জন যুগ্ম সচিব, ৮ জন অতিরিক্ত সচিব এবং ৬ জন সচিবকে ওএসডি করা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের ৮০ জন ডিআইজি, ৩০ জন পুলিশ সুপারসহ ১১০ জনকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। একজন ডিআইজি, একজন অ্যাডিশনাল ডিআইজি এবং চারজন পুলিশ সুপারকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। আইজিপিসহ ১০ জন অতিরিক্ত আইজি, ৮৮ জন ডিআইজি, ২১ জন অ্যাডিশনাল ডিআইজি এবং ১৭৭ জন পুলিশ সুপারসহ মোট ২৯৭ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।’
সংস্কার আনতে প্রাথমিকভাবে ৬ কমিশন গঠন, কাজ শুরু অক্টোবরে
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বার্তা ও আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য কিছু জাতীয়ভিত্তিক সংস্কার সম্পন্ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্রে রেখে ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে ৬টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এসব কমিশন আগামী ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করবে।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখে এবং হাজারো মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের বার্তা ও আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য একটি অভূতপূর্ব সময় ও সুযোগ আমরা অর্জন করেছি। এর বাস্তবায়ন তথা বাংলাদেশে ফ্যাসিজম বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রোধ এবং জনমালিকানা ভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে কিছু জাতীয়ভিত্তিক সংস্কার সম্পন্ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। উক্ত সংস্কার ভাবনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি বলেন, আমরা যেহেতু জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের মালিকানায় বিশ্বাস করি, সেহেতু নির্বাচনব্যবস্থার উন্নয়নে আমাদের সংস্কার ভাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা মনে করি নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা এর মাধ্যমে এক ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো গোষ্ঠীর কাছে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব আশঙ্কা রোধ করার জন্য নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কথা আমরা ভাবছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন- এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানা ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এর পাশাপাশি করে সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি।
এসব বিষয়ে সংস্কার করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে কমিশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। এরপর আরও বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রাখবো।
প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সরফরাজ চৌধুরী, বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন।
এসব কমিশনের অন্য সদস্যদের নাম কমিশন প্রধানদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। কমিশনগুলোর আলোচনা ও পরামর্শসভায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র-শ্রমিক-জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
ড. ইউনূস বলেন, পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে শুরু করতে পারবে বলে আশা করছি এবং এটি পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আমরা ধারণা করছি। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শসভার আয়োজন করবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র সমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এতে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার একটি ধারণাও দেওয়া হবে।
এই আয়োজন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তা বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্র পুনঃনির্মাণ তাগিদের ঐক্যবন্ধনে গোটা জাতিকে শক্তিশালী ও আশাবাদী করে তুলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে
গণ-অভ্যুত্থানে নিহত সকল পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, ‘আমি আগেও জানিয়েছি, আবারও জানাচ্ছি, গণ-অভ্যুত্থানে সকল শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। সকল আহত শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করবে সরকার। আহতদের দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন নতুন তথ্য পাওয়ার ভিত্তিতে এই তালিকা হালনাগাদ করা হতে থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই গণ-অভ্যুত্থানের শহিদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকার তার যাত্রা লগ্নে ‘জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এখন সে ফাউন্ডেশন তৈরি হয়েছে। সব শহীদ পরিবার ও আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসাসহ তাদের পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এই ফাউন্ডেশন গ্রহণ করছে। এই ফাউন্ডেশনে দান করার জন্য দেশের সব মানুষ ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।”
গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে
সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মিডিয়া যাতে কোনো রকম বাধা বিপত্তি ছাড়া নির্বিঘেœ তাদের কাজ করতে পারে সেজন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন। আরও যেসব কমিশন সরকারসহ অন্য সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে, আমরা তাদের পুনর্গঠন ও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি যাতে তারা আরও শক্তিশালী হয়, জনকল্যাণে কাজ করে।
সব ‘আয়নাঘর’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দিন-রাত পরিশ্রম করছে, উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আয়নাঘরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বের হয়ে আসছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের গুমের শিকার ভাই-বোনদের কষ্ট ও যন্ত্রণাগাথা।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সম্প্রতি আমরা বলপূর্বক গুম থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন সনদে স্বাক্ষর করেছি। ফলে, স্বৈরাচার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘গুম সংস্কৃতির’ সমাপ্তি ঘটানোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। এছাড়া, আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করার জন্য পৃথক একটি কমিশন গঠন করছি। যেসব পরিবার তাদের নিখোঁজ পিতা, স্বামী, পুত্র ও ভাইদের পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে যন্ত্রণার সঙ্গে অপেক্ষা করছেন, আমরা আপনাদের বেদনায় সমব্যথী।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যেসব ভাই-বোন গত ১৬ বছরের বেদনা জানিয়ে তার প্রতিকার পাওয়ার জন্য আমার অফিস ও সচিবালয়ের অফিসসমূহের সামনে প্রতিদিন ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে আমাদের কাজ-কর্ম ব্যাহত করছিলেন, তারা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘেরাও কর্মসূচি থেকে বিরত হয়েছেন বটে; তবে অন্যত্র আবার তারা তাদের কর্মসূচি দিয়ে যাতায়াতে ব্যাঘাতও সৃষ্টি করেছেন। আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের ন্যায্য আবেদনের কথা ভুলে যাবো না। আমরা সব অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আমাদের দায়িত্বকালে যথাসম্ভব সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব। অনুরোধ করছি, আপনার যাতায়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টি থেকে বিরত থাকুন। জাতি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব অনেক। ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ গড়ে তোলার জন্য একসঙ্গে অনেকগুলো কাজে আমাদের হাত দিতে হবে। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনকে দমন করতে যে-সব ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এরমধ্যে হত্যা মামলা ছাড়া বাকি প্রায় সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতার করা সবাই মুক্তি পেয়েছেন।
কারখানা খোলা রাখুন, অর্থনীতিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিন
শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট আঘাত আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
পোশাক কারখানায় চলমান শ্রমিক অসন্তোষের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তৈরি পোশাক, ওষুধ শিল্প এসব এলাকায় শ্রমিক ভাইবোনেরা তাদের অভিযোগ জানানোর জন্য ক্রমাগত এই শিল্পের কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধ রাখতে বাধ্য করছেন। এটা আমাদের অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটা মোটেই কাম্য নয়।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এমনিতেই ছাত্র-শ্রমিক জনতার বিপ্লবের পর যে অর্থনীতি আমরা পেয়েছি সেটা নিয়ম নীতিবিহীন দ্রুত ক্ষীয়মাণ একটা অর্থনীতি। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আমরা এই অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করছি। আমাদের উদ্যোগে সাড়াও পাচ্ছি। ঠিক এই সময়ে আমাদের শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে, অকার্যকর হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট আঘাত পড়বে। সেটা কিছুতেই কারও কাম্য হতে পারে না।’
শ্রমিকদের সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেন, ‘শ্রমিক ভাইবোনদের অনেক দুঃখ আছে। কিন্তু সেই দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে আপনাদের মূল জীবিকাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে সেটা ঠিক হবে না। দেশের অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে সেটা ঠিক হবে না। শ্রমিক-মালিক উভয়পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান আমরা অবশ্যই বের করবো। আপনারা কারখানা খোলা রাখুন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখুন। দেশের অর্থনীতিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিন।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা আপনাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান বের করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করবো। মালিকপক্ষের কাছে আমাদের আবেদন, আপনারা শ্রমিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করুন। কারখানা সচল রাখুন। অর্থনীতির দুর্বল স্বাস্থ্যকে সবল করে তুলুন।’
ঔষধ ও তৈরি পোশাক শিল্পের সমস্যা চিহ্নিত করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওষুধ শিল্প এবং তৈরি পোশাক শিল্প দেশের গৌরব। এর মাধ্যমে আমাদের শ্রমিক ভাইবোনেরা ও তাদের কর্মকুশলতা বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে। এর সাফল্য এখন থমকে আছে। আমরা এই দুই শিল্পকে তাদের সম্ভাব্য শীর্ষে নিয়ে যেতে চাই। দুর্বল করার তো প্রশ্ন উঠেই না। এই দুই শিল্পের কোথায় কোথায় বাধা আছে, সমস্যা আছে সেগুলো চিহ্নিত করে তাকে বাধা মুক্ত করতে চাই।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা বিদেশি ক্রেতাদের একত্রিত করে তাদের সহযোগিতা চাইবো যেন বাংলাদেশের এই শিল্প দুটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের চাইতে বেশি আস্থাযোগ্য হয়ে গড়ে উঠতে পারে। সব কিছুই সম্ভব যদি আমরা শ্রমিক-মালিক সম্পর্কটা একটা নির্ভরযোগ্য, আনন্দদায়ক করে গড়ে তুলতে পারি। আমাদের সরকারের প্রথম মাস কাটলো। দ্বিতীয় মাস থেকে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি হিসেবে নতুন শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের সূচনা করতে চাই। এটা দেশের সবার কাম্য। দেশের নতুন প্রজন্ম নির্ভয়ে যেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি।”