৬১ জেলা পরিষদের সকল সদস্যও অপসারিত
সিলেটসহ দেশের ১২ সিটি কর্পোরেশন, ৩২৩ পৌরসভার সব কাউন্সিলরকে অপসারণ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:১৩:১১ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম :
সিলেটসহ দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশন ও ৩২৩টি পৌরসভার সকল কাউন্সিলর এবং ৬১টি জেলা পরিষদের সকল সদস্যকে অপসারণ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের (এলজিআরডি) স্থানীয় সরকার বিভাগের তিনটি পৃথক প্রজ্ঞাপনে তাদেরকে অপসারণ করা হয়। এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম ১২টি সিটি কর্পোরেশনের সব কাউন্সিলরকে অপসারণের বিষয়টি সিলেটের ডাককে নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া, মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ৩২৩টি পৌরসভা ও ৬১ জেলা পরিষদের (পার্বত্য তিন জেলা বাদে) সব সদস্যকে অপসারণের প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সিটি কর্পোরেশন-১ শাখার উপ-সচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর ধারা ১৩ ক প্রয়োগ করে বাংলাদেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরগণকে (সংরক্ষিত আসনসহ) স্ব স্ব পদ হতে অপসারণ করা হলো। প্রজ্ঞাপনে জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
যেসব সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- ঢাকা দক্ষিণ সিটি, ঢাকা উত্তর সিটি, চট্টগ্রাম , খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন।
এছাড়া, স্থানীয় সরকার বিভাগের পৌর-১ শাখার উপ-সচিব মো: মাহবুব আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে দেশের ৩২৩টি পৌরসভার সাধারণ আসনের কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলদের অপসারণ করা হয়।
এছাড়া, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জেলা পরিষদ শাখার উপসচিব মো: হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে দেশের ৬১টি জেলা পরিষদের সকল সদস্য ও মহিলা সদস্যকে অপসারণ করা হয়।
গতরাতে এসব প্রজ্ঞাপন ভাইরাল হয় সোস্যাল মিডিয়ায়। অনেকেই পত্রিকা অফিসে ফোন করে প্রজ্ঞাপনের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চান। পরে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ওয়েবসাইট থেকে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
এর আগে গত ১৯ আগস্ট দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, ৬১টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সারা দেশের সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। স্থানীয় সরকারের এই চার স্তরে সব মিলিয়ে সে সময় ১ হাজার ৮৭৬ জন জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করা হয়।
অপসারণ করা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের জায়গায় সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আগে সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হতো। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। শুরুর দিকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। তবে সেখানে ব্যাপক কারচুপি, দখলের অভিযোগ ওঠে। পরে ক্রমে বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন শুরু করে। সম্প্রতি পদত্যাগ করা হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীন কোনো নির্বাচনে দলটি অংশ নেয়নি। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ এ বছর অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী দেয়নি। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা কর্মী জয়ী হন। সিটি কর্পোরেশনের ভোটেও একই চিত্র দেখা গেছে। কার্যত জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে ছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুথানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। তখন থেকে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। পরে বিকল্প ব্যবস্থা করে সরকার। যেমন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এরপর অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন সংশোধন করে মেয়র-চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ তৈরি করে সরকার।
সম্প্রতি ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পরে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। ওই সংশোধনীর ফলে বিশেষ পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে সরকার জনস্বার্থে কোনো সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরকে অপসারণ করতে পারবে। একইভাবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করতে পারবে। একই সঙ্গে এগুলোয় প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে সরকার।
অপসারণের পর ১২টি সিটি কর্পোরেশনেই প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে অতিরিক্ত সচিব ও সমমর্যাদার চার কর্মকর্তাকে প্রশাসক করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে বিভাগীয় কমিশনারদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এর আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের পৃথক প্রজ্ঞাপনে দেশের ৪৯৩টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হয়। একটি উপজেলার চেয়ারম্যান মারা যাওয়ায় পদটি শূন্য হয়। তাঁদের জায়গায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া দেশের ৬১টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদেরও অপসারণ করা হয়েছে। আর মৃত্যুর কারণে নাটোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হয়েছে। তাঁদের জায়গায় ৮টি জেলা পরিষদের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) এবং ৫৩টি জেলা পরিষদে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব কর্মকর্তা নিজ নিজ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন। উল্লেখ, তিন পার্বত্য জেলায় ভিন্ন নিয়মে চলে। তাই সেগুলোতে পরিবর্তন হয়নি।
সব পৌরসভার (৩২৩টি) মেয়রদেরও অপসারণ করা হয়েছে। সাতটি পৌরসভায় আগে থেকেই প্রশাসক ছিলেন। তাঁদের সরিয়ে এবার সব মিলিয়ে ৩৩০টি পৌরসভায় নতুন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জেলায় কর্মরত স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)।