রাজনৈতিক ঐক্য ও বাংলাদেশের নিয়তি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১:৫৯:২৪ অপরাহ্ন
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ :
ঐক্যবদ্ধ জাতি সামনের দিকে অগ্রসর হয়, আর দ্বিধাবিভক্ত ও বহুধাবিভক্ত জাতি যেখানে আছে, সেখানেই পড়ে রয়। বলা যায় পিছনের দিকে হাঁটে। পৃথিবীতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে বহু দেশ সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছে, এমন উদাহরণ যেমন আছে, ঠিক তেমনি দ্বিধাবিভক্ত ও বহুধাবিভক্ত জাতি ধ্বংস হয়ে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, এমন কিছু উদাহরণও আছে। ঐক্যবদ্ধ থাকার সুফল এবং বিভক্তির কুফল সম্পর্কে গ্রীক গল্পকার Aesop বলেছেন “United we stand divided we fall” (অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধতায় আমরা দাঁড়াই, বিভক্তিতায় আমরা পড়ে যাই)।
বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক প্রবণতা লক্ষ করা গেছে যে, কঠিন দুর্যোগে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, কিন্তু সুদিনে তারা হয় দ্বিধাবিভক্ত বা বহুধা বিভক্ত। বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডে গত ৫৪ বছরে অন্তত তিনবার বড় ধরণের দুর্যোগ নেমে এসেছে। এই তিনবারই জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই দুর্যোগ বা দুর্দিন মোকাবেলা করেছে। কিন্তু দুর্যোগের পর সুদিন যখন আসে, তখন তারা তাদের ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি। বরং করেছে পারস্পরিক কামড়াকামড়ি, দোষারোপ, গালাগালাজ ও আক্রমণ।
১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ও গণহত্যার প্রতিবাদে এই ভূখণ্ডের মানুষ ফোঁসে ওঠে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, রূপ নেয় এক সর্বাত্মক জনযুদ্ধে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আনতে জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ। বুকভরা আশা ও আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা নিয়ে স্বাধীনতা আনলেও অল্পদিনের মধ্যে সেই আশা ও প্রত্যাশায় গুড়ে বালি পড়ে। জাতি অল্পদিনের মধ্যে হয় দ্বিধাবিভক্ত। গণতন্ত্রের চেতনায় দেশ স্বাধীন হলেও নতুন দেশের যাত্রা শুরু হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে। সব সংবাদপত্র বন্ধ করে রাখা হয় চারটি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা। এমন পরিস্থিতিতে ঘটে পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। এতো আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত নতুন স্বাধীন দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না।
এরপর অনেক উত্থান পতনের পর আশির দশকের গোড়ার দিকে দেশ পড়ে দীর্ঘ মেয়াদী এক স্বৈরাচারের কবলে। রাজনৈতিক দলগুলো ও জনতার সম্মিলিত প্রায় এক দশকের ধারাবাহিক আন্দোলন ও সর্বশেষ গণঅভ্যুত্থানে নব্বই দশকের শেষের দিকে স্বৈরাচারের পতন হয়। মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচে। আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের কঠিন দিনগুলোতে গড়ে ওঠে ঐক্য, রচিত হয় তিন জোটের লিখিত রূপরেখা। মানুষ মনে করেছিল বাংলাদেশ গণতন্ত্রে স্থায়ীভাবে পদার্পণ করেলো। খুব বেশীদিন যায়নি মানুষের এ আশা ভঙ্গ হতে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রায় এক যুগের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা জোটগুলোর লিখিত রূপরেখা পরবর্তীতে নির্বাচিত হয়ে আসা সরকার কিছুটা পূর্ণ করলেও (যেমন সংসদীয় গণতন্ত্রে পদার্পণ ও বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের দায়িত্বকে বৈধতা) বেশিরভাগ রয়ে গেল অপূর্ণ। ফলে সরকারে থাকা দল ও সরকারের বাহিরে থাকা দলগুলোর মধ্যে তৈরি হয় অনৈক্য ও অবিশ্বাস যা পরবর্তীতে গড়ায় রাস্তার হিংসাত্মক আন্দোলনে। পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা।
২০০৮ সালের নির্বাচনে একটি দল ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সবকিছু কুক্ষিগত করা শুরু করলো। সবকিছু দলীয়করণ করে এমন ফ্যাসিবাদি শাসন প্রতিষ্ঠা করলো যে ভিন্নমত ও ভিন্নমতের ধারকদেরকে হামলা, মামলা, খুন ও গুম যেন দেশের নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেড় যুগের উপর চলে এমন শাসন। এই দীর্ঘ সময়ের শাসনামলে নির্বাচনকে একেবারে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। দেড় দশকে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করে ফ্যাসিবাদি শাসনের কোন টনকই নড়াতে পারছিলো না। এমন প্রেক্ষাপটে চাকুরিতে কৌটা বিরোধী আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো তা ছড়িয়ে পড়ে সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনে। মাত্র ছয় সপ্তাহের আন্দোলন রুপ নেয় স্বতঃস্ফূর্ত এক গণঅভ্যুত্থানে। যার ফলশ্রুতিতে পতিত সরকার প্রধান ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
পতিত সরকার গণঅভ্যুত্থানকে দমন করার জন্য হেন কোন কাজ নেই যা করেনি। নিজের দল ও ছাত্র সংগঠনকে অস্ত্র সরবরাহ করত ছাত্রজনতার উপর লেলিয়ে দিয়েও কাজ হয়নি। উচ্চআদালতকে ব্যবহার করেও ব্যর্থ হন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে চালানো হয়েছে গণহত্যা যার ফলশ্রুতিতে জীবন দিনে হয়েছে সহস্রাধিক ছাত্র জনতাকে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ও আহত হয়েছেন বিশ থেকে ত্রিশ হাজারের অধিক। এখনও অনেক আহতরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন।
গণঅভ্যুত্থানে জাতি যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য দেখেছিল গত বছরের পাঁচই আগস্টের পর কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই ঐক্যে ফাটল ধরা শুরু করে। রাজনৈতিক দলগুলো দেশের বৃহত্তর স্বার্থের চেয়ে তারা ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া শুরু করে। ফলে শুরু হয়ে পারস্পরিক দোষারোপ, আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ। অভ্যূত্থান-উত্তর জটিল পরিস্থিতিতে নতুন সম্ভাবনায় দেশকে এগিয়ে নিতে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সীশাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্য থাকার কথা, সেখানে শুরু হয় বিভাজন, অপবাদ ও গালাগালির প্রতিযোগিতা। দীর্ঘদিন একসঙ্গে জোটে থাকা, আন্দোলন করা ও সরকারে থাকা বড় দল দুটির মধ্যে চলে গালিগালাজ, আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ। বড় আফসোস, জাতির দুর্দিনে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে কিন্তু জাতির সুদিনে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ গড়তে পারে না। এটাই যেন হয়ে গেছে বাংলাদেশের নিয়তি।
রাজনীতিতে মতানৈক্য, দ্বিমত, তর্ক, পাল্টা-তর্ক, আলোচনা ও সমালোচনা থাকতেই পারে, থাকা স্বাভাবিক। বরং এগুলো থাকা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য (beauty)। তবে এগুলো যেন রাজনৈতিক ব্যাকরণের বাইরে না যায় সেটা সংশ্লিষ্ট মহলকে নিশ্চিত করতে হবে। গালাগালি ও মিথ্যা অপবাদ আর দ্বিমত ও সমালোচনা এক জিনিস নয়। শেষের দুটি রাজনীতির জন্য অপরিহার্য হলেও প্রথম দুটি রাজনীতিকে করে বিষাক্ত। এই দুই মেরুর সীমারেখা টানতে না পারলে রাজনীতিকে কখনও পেশীশক্তি, অর্থ পাচারকারী ও দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না।
গত ৫৪ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে কত আন্দোলন হলো, কত জীবন দিতে হলো, কত রক্ত ঝরলো, কত মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করলো, কত লোক তার নিকটাত্মীয়কে হারালো। আর কত রক্ত ঝরাতে হবে, আর কতো জীবন দিতে হবে, আর কত মায়ের বুক খালি হতে হবে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য? স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও যদি জাতির মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে তাহলে জাতি গঠন হবে কিভাবে? জাতি সামনের দিকে এগুবে কিভাবে? আমাদের মতো প্রায় একই সময় স্বাধীন হয়ে সে সব দেশ আজ কোথায় আর আমরা কোথায় পড়ে আছি। রাজনৈতিক দলগুলোর সত্যকারের আত্মসমালোচনা (soul-searching) করা দরকার।
বিভিন্ন চাকচিক্যময় ও মতলবি বয়ান (narrative) প্রতিষ্টা ও চালু করে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত ও বহুধাবিভক্ত করে রাখলে দেশ এগিয়ে না গেলেও যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়। এমন শাসনব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়, ক্ষমতা হয় দীর্ঘস্থায়ী। এমনটি দেড় দশকে প্রতিষ্ঠা করে গেছে পতিত সরকার। আমরা সেই ফ্যাসিবাদী মনোভাব ও উদ্যোগকে ঘৃণা করি। আর এই ঘৃণাতেই গণতন্ত্রমনা মানুষের স্বার্থকতা। Clash of Civilisation বইয়ের লেখক হার্বার্ড প্রফেসর সামিউল হান্টিংটনের ভাষায় “Unless we can hate what we are not we cannot truely love what we are” (অর্থাৎ “আমরা যা নই তা ঘৃণা না করতে পারলে, আমরা যা তা সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারব না”)।
আসুন, আমরা বাংলাদেশে দেশ গড়ার রাজনীতি শুরু করি। “ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে দেশ বড়” এটা শুধু কথার কথা বা শ্লোগানের মধ্যে না রেখে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করি। দেশকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক্য। জাতির মহা সংকটে জাতীয় ঐক্যের নমুনা আমরা বারবার দেখিয়েছি। কিন্তু সংকট-উত্তর আমরা সেই ঐক্যকে ধরে রাখার নমুনা জাতিকে এখনো দেখাতে পারিনি। গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের জন্য মহা সুযোগ এসেছে। এমন সুযোগ হয়তো আমাদের জীবদ্দশায় আর আসবে না। জাতির দুর্দিনে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে কিন্তু জাতির সুদিনে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ গড়তে পারে না- বাংলাদেশের এই নিয়তি ভাঙ্গতে হবে। আর এই নিয়তি ভাঙ্গতে পারে জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা সব রাজনৈতিক দলগুলো জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থেকে।
লেখক : আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।




