বিধ্বস্ত ভূমিতে মানুষের আর্তনাদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ৫:৩৯:২৪ অপরাহ্ন
ফায়যুর রাহমান :
গাজার নিষ্ঠুর যুদ্ধ তৃতীয় বছরে গড়ালো। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর এটা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, যে যুদ্ধের পরই অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্ম হয়েছিল।
গত দুই বছরে গাজায় ইসরায়েল যেটা করেছে, ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, ১ লাখ ৭০ হাজার ফিলিস্তিনিকে গুলি করে ও বোমায় পুড়িয়ে পঙ্গু-আহত করেছে, গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, যে ধ্বংসস্তূপের নীচে অসংখ্য বনি আদমের মৃতদেহ চাপা পড়ে আছে। লাখো ফিলিস্তিনি নিখোঁজ, যাদের কোনো খবর নেই, কবর নেই, কোনো নথিতে তাদের নাম নেই, যেন তারা কখনোই পৃথিবীতে ছিল না।
ইসরায়েলের একেকটি বিমান হামলায় ফিলিস্তিনিদের পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কখনো শুধু একজন মানুষ বেঁচে আছে, যে হচ্ছে শিশু। এই শিশু আবার ধ্বংসস্তূপের মাঝে ক্ষুধা ও অপুষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছে ত্রাণের, কোনো সাহায্যকারীর।
গাজার ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়া মৃতদেহ, আহত হয়ে চিকিৎসা না পাওয়া জীবিত মানুষ, ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে পথ চেয়ে থাকা অসহায় শিশু সভ্য দুনিয়ার জন্য লজ্জার। এই লজ্জা ব্যর্থতার লজ্জা। মানবতার পরাজয়ের লজ্জা। এই যে এত মানুষের হাহাকার, বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া মানবদেহ, ছিন্নভিন্ন দেহে হারিয়ে যাওয়া বনি আদম, ইসরায়েলের গোপন বন্দিশিবিরে আটক ফিলিস্তিনি, তাদের জন্য কি দুনিয়ার কোনো আইন নেই, কুটনীতি নেই?
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে এক আকস্মিক হামলার প্রেক্ষিতে এই যুদ্ধের সূচনা। সেই হামলায় বারশো’র মতো ইসরায়েলি নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হয়। এরপর থেকেই গাজা পরিণত হয় ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপে, যেখানে মানুষের জীবন, শহরের দালান, অবকাঠামো- সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।
এখন গাজার বাসিন্দারা বাস্তুচ্যুত, ছিন্নমূল। দৌড়ের উপর জীবন, বোমা থেকে বাঁচতে বারবার আশ্রয় বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। সম্পূর্ণ শহর ধুলায় মিশে গেছে, ভেঙে পড়েছে কংক্রিটের স্তূপে। হামলার সাক্ষীরা, ত্রাণ কেন্দ্রের আশেপাশে সহিংসতার শিকার মানুষেরা, আহতদের দ্বারা উপচে পড়া হাসপাতালের চিকিৎসকরা- সবাই এক সুরে বলছেন, ‘এ যেন পৃথিবীর নরক’, ‘ যেন কেয়ামতের দৃশ্য’।
এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই নিরীহ মানুষ। এর মধ্যে অন্তত ২০ হাজার শিশু। আহতের সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার। এছাড়া বহু ফিলিস্তিনি মারা গেছে অনাহারে, আশ্রয় ও ওষুধের অভাবে, দুর্ঘটনায়, সংক্রামক রোগের দ্রুত বিস্তারে এবং ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে। বিখ্যাত চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেট-এর গবেষণা অনুসারে, যুদ্ধের প্রথম বছরেই গাজার মানুষের গড় আয়ু অর্ধেকে নেমে আসতে পারে।
ইসরায়েলের বিমান হামলায় ফিলিস্তিনিদের চার লাখ ৩৬ হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। ২১ লাখ গাজাবাসী বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ইসরায়েলি কৌশল হিসেবে গাজার আনুমানিক ২ লাখ ৫০ হাজার ভবনের ৭৮ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। এতে প্রায় ৬১ মিলিয়ন টন ধ্বংসস্তুপ তৈরি হয়েছে, যার প্রায় ১৫ শতাংশে অ্যাসবেস্টস, শিল্পবর্জ্য বা ভারী ধাতুর মতো বিষাক্ত উপাদান।
বর্তমানে গাজার মোট ভূখণ্ডের ৮০ শতাংশেরও বেশি এলাকা ইসরায়েলি সামরিক ‘উচ্ছেদ নির্দেশ’ বা ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ ঘোষণার আওতায় রয়েছে। অর্থাৎ এসব স্থানে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সম্প্রতি ইসরায়েলের নতুন অভিযান গাজা সিটির দিকে পরিচালিত হয়, যেখানে অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত বিপুলসংখ্যক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। সেই হামলার পর আবারও লক্ষাধিক মানুষ পালাতে বাধ্য হয়েছে। সব মিলিয়ে, ত্রাণ সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যা মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ।
বর্তমানে লক্ষাধিক মানুষ দক্ষিণাঞ্চলের আল-মাওয়াসিসহ গাজার বিভিন্ন স্থানে তাঁবু শহর ও অতিরিক্ত ভিড়ের আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে। যেখানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং বিশুদ্ধ পানির প্রবেশাধিকার অত্যন্ত সীমিত। বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ মানুষ দিনে ছয় লিটার পানযোগ্য পানিও পাচ্ছে না, আর পাঁচ লাখ মানুষ নয় লিটারেরও কম পানিতে টিকে আছে। মধ্যযুগীয় মসজিদ, অটোমান যুগের বাজার, গির্জা এবং প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর বহু অংশ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে অথবা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
৫১৮টি স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে ৭ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী এখন শিক্ষার বাইরে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজার এই ৭ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী ক্লাসের বাইরে। এর মধ্যে ৮৮ হাজার উচ্চশিক্ষার্থী তাদের পড়াশোনা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে।
জাতিসংঘের ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত অনেক স্কুল এখন জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। ইসরায়েল এসব স্কুলেও একাধিকবার বোমা নিক্ষেপ করেছে। ইসরায়েলের দাবি, এসব হামলা হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ করে চালানো হয়েছে। কারণ তারা এসব ভবনে অবস্থান নেয় এবং সাধারণ নাগরিকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।
গত দুই বছরে ইসরায়েলি সেনারা ৬৫৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলা করে এক হাজার সাতশো’ জনের বেশি স্বাস্থ্যকর্মীকে হত্যা করেছে। গত মাস পর্যন্ত গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৪টি আংশিকভাবে কার্যকর ছিল। দক্ষিণ গাজায় এনজিও ও বিদেশি সরকারগুলো স্থাপন করেছে ১৬টি অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতাল, যেগুলো আংশিক চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। তবে সেগুলোও সব সময় রোগীতে উপচে পড়ছে। চিকিৎসকদের রিপোর্ট অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে উত্তর গাজার আল-শিফা হাসপাতালে শয্যা-দখল হার ২৪০% এবং আল-আহলি হাসপাতালে ৩০০% ছুঁয়ে গেছে।
প্রায় সব হাসপাতালই ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ১১ জুন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ৭৩৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। যেখানে ৯১৭ জন নিহত ও এক হাজার ৪১১ জন আহত হয়েছেন। চিকিৎসক ও প্যারামেডিকদের অনেককে ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা, আহত, আটক ও নির্যাতন করেছে।
গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের ফলে ৪০০ ফিলিস্তিনি ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে মারা গেছে। জাতিসংঘের হিসাবে, সংঘাত শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে পুষ্টিহীনতার কারণে, যাদের মধ্যে ১০১ জন শিশু। এর বেশিরভাগ মৃত্যুই ঘটেছে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে। বর্তমানে দশ হাজারেরও বেশি শিশু জরুরি খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। ২০২৫ সালের আগস্টে জাতিসংঘ-সমর্থিত বিশেষজ্ঞরা গাজার কিছু অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেন। অক্টোবর নাগাদ ত্রাণকর্মীরা জানান, গাজার অধিকাংশ গর্ভবতী মা দিনে মাত্র একবেলা খাবার পাচ্ছেন।
ইসরায়েল পুরো যুদ্ধজুড়ে গাজায় ত্রাণ প্রবেশে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। একই সঙ্গে কৃষি উৎপাদন ধ্বংস করায় খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধবিরতির সময় সামান্য উন্নতি দেখা দিলেও ইসরায়েল একতরফাভাবে যুদ্ধ পুনরায় শুরু করে এবং টানা দুই মাস- মধ্য মে পর্যন্ত- সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ রাখে। এরপর সীমিত পরিসরে কিছু নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গঠিত বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ খাদ্য বিতরণের কাজ শুরু করলেও তার কার্যক্রমের সময় ইসরায়েলি সেনাদের গুলতে এক হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে।
২০২৩ সাল থেকে গাজার কৃষিজ সম্পদ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ৯৭% গাছের ফলন, ৯৫% বনভূমি, এবং ৮২% বার্ষিক শস্যক্ষেত ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলে বৃহৎ পরিসরে খাদ্য উৎপাদন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পরিবেশবিদ ও গবেষকদের মতে, এই ধ্বংস গাজার পরিবেশব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্য, খাদ্যনিরাপত্তা ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
২০২৫ সালের আগস্টে জাতিসংঘ প্রকাশিত নতুন তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গাজার মাত্র ১.৫% কৃষিজমি চাষাবাদের উপযোগী রয়েছে। যুদ্ধাস্ত্র ও অগ্নিকাণ্ডের বিষাক্ত রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ মাটি ও পানির উৎস মারাত্মকভাবে দূষিত করেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত মাইন অ্যাকশন পার্টনাররা গাজায় ১৩২টি বিস্ফোরক সংক্রান্ত ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। যেখানে ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ১৪ জন শিশু। এছাড়া ২৪৯ জন আহত, যাদের মধ্যে অন্তত৭১ জন শিশু রয়েছে।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পরিস্থিতি দিনদিন আরও ভয়াবহ হচ্ছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে এটি এমন এক পরিবেশগত বিপর্যয়ের উত্তরাধিকার তৈরি করবে, যার প্রভাব গাজার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপর দীর্ঘকাল ধরে পড়বে।’
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।




