লাখ লাখ কওমি শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৭:১৮:২৮ অপরাহ্ন
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ :
বাংলাদেশের হাজার হাজার কওমি মাদরাসা থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে বের হচ্ছে। কিন্তু তারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোনো কাজে যোগ দিতে পারে না। যোগ দেয়া তো দূরের ব্যাপার, রাষ্ট্রের বা সরকারি কোনো চাকুরিতে আবেদনই করার যোগ্যতাই (eligibility) তাদের থাকে না। তাদের একমাত্র ও কেবল মাত্র ক্যারিয়ার প্রস্পেক্ট হচ্ছে মাদ্রাসায় চাকরি খোঁজা বা মসজিদে ইমাম বা মোয়াজ্জিনের কাজ খোঁজা। মাদ্রাসা ও মসজিদে কাজ পেতেও তাদের সীমাবদ্ধতা আছে, কেননা কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে আলিয়া মাদ্রাসায় তারা চাকুরি পায় না। আবার সব মসজিদেও তাদের নেয় না। তাদেরকে কেবল খুঁজতে হয় কওমি মাদ্রাসায় চাকুরি এবং কওমিপন্থী মসজিদে চাকুরি। স্বাধীন বাংলাদেশে এমনটি চলে আসছে বিগত ৫৪ বছর ধরে।
প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী কওমি মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে আসা গত ৫৪ বছরে এই সংখ্যা যে কত ব্যাপক হবে তা সহজেই অনুমেয়। এই সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- একটি রাষ্ট্রের এত বিপুল সংখ্যক নাগরিককে পাশ কাটিয়ে বা মূলধারার শিক্ষার বাইরে রেখে বা রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত রেখে রাষ্ট্র কতটুকু অগ্রসর হতে পারবে? এমন অদ্ভুত (peculiar) অবস্থা পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে।
মজার ব্যাপার হলো পতিত সরকার কওমির দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমর্যাদা দিলে কওমিদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। তারা এতোটা আনন্দে আত্মহারা ছিলেন যে ঘটা করে শোকরানা মাহফিল অনুষ্ঠান করেন এবং এতে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড গওহরডাঙ্গার চেয়ারম্যান ও গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মহাপরিচালক মুফতি রুহুল আমীন ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে “কওমি জননী” উপাধিতে পর্যন্ত ভূষিত করেন! কিসে নিজেদের লাভ, কোনটা নিয়ে রাজনীতি করা হয়, কোনটা “মুখে শেখ ফরিদ কিন্তু বগলে ইট” স্বভাবের মায়াকান্না এগুলো বুঝতে না পারলে নিজের অধিকারটুকু আদায় করবেন কিভাবে?
নিম্নস্তরের কোনো সনদের যেখানে রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি নাই, সেখানে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমর্যাদা দিয়ে কি উপকারটা হলো আমার বুঝে আসে না। এ যেন বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন ও দেয়াল নির্মাণের আগেই ছাদ বানানোর হাঁস্যকর চেষ্টা! রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রধান পাবলিক পরীক্ষা বিসিএসে অংশগ্রহণ করতে যেখানে ডিগ্রি বা সমমান বাধ্যতামূলক সেখানে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমর্যাদা দেয়ায় কি অধিকার আদায় হলো? এ যেন অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মত। অথচ উচিত ছিল সরকারের সাথে শক্তহাতে দেনদরবার করে যথাযথ রিভিউ, সংস্কার, বর্ধিত ও মৌলিক বিষয়গুলো (যেমন: অংক, ভূগোল, বিজ্ঞান, ভাষা, ইতিহাস প্রভৃতি) অন্তর্ভুক্ত করে অন্যান্য সনদগুলোর যথাযথ মান নিশ্চিতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায় করা।
বাংলাদেশে কয়েক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান। মোটাদাগে আধুনিক শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা নামে দু’ভাগ করলেও প্রতিটি ভাগ আবার কয়েকটি উপভাগে বিভক্ত। মাদ্রাসা শিক্ষা প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত: আলিয়া শিক্ষা ব্যবস্থা ও কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা। আধুনিক শিক্ষাকেও আবার দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে: বাংলা মাধ্যমে পড়শুনা ও ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশোনা। এর মধ্যে আবার বিদেশি কারিকুলামে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাও আছে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া মোটামুটি আর সব ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা মূলধারার সাথে কোন না কোনোভাবে সম্পৃক্ত আছে। অর্থাৎ কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পড়াশোনা করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যেতে পারবে, পারবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় কাজে সম্পৃক্ত হতে।
তবে বলে রাখা ভাল যে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কাজে যোগদানে কিছুটা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা আছে। যেমন: দাখিল ও আলিম পরীক্ষাকে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সমমর্যাদা দেয়া হলেও ফাজিল ও কামিলকে যথাক্রমে ডিগ্রির কোন মান ও মাস্টার্সের পূর্ণ মর্যাদা দেয়া হয়নি। ফলে আলিয়া মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ফাজিল ও কামিল পাশ করে কোন শিক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। বিদ্যমান এই প্রতিবন্ধকতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে মাদ্রাসায় দাখিল ও আলিম পাশ করে ফাজিলে ভর্তি না হয়ে বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি তথা সম্মান কোর্সে ভর্তি হচ্ছে।
আশ্চর্যজনকভাবে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল টাইম ডিগ্রি ও মাস্টার্স করা অবস্থায় অনেকটা লুকিয়ে বা গোপনে সমান্তরাল ফুল টাইম পড়াশোনা করে ফাজিল ও কামিল পাশ করছে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে। আবার অনেকে মাদ্রাসায় দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল সম্পন্ন করে বহু বছর গ্যাপ দিয়ে নতুন করে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিতে পড়াশুনা করছে। পড়াশোনার এই দীর্ঘসূত্রিতার যাঁতাকলে পড়া শিক্ষার্থীরা অনেকটা বাধ্য হয়ে সার্টিফিকেটে বয়স কমিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আলিয়া মাদ্রাসা থেকে এভাবে প্রচলিত আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আসা বা গ্যাপ দিয়ে পড়াশুনা করা বা সমান্তরাল পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও কওমি মাদ্রাসা থেকে এসে এভাবে করা অসম্ভব।
অনেকে প্রশ্ন তুলতে পাবেন আলিয়া মাদ্রাসার ফাজিল দুই বছরের কোর্স অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ডিগ্রি কোর্স তিন বা চার বছরের। সুতরাং কিভাবে সমমর্যাদা দেয়া হবে? প্রশ্নটা যৌক্তিক বটে। তবে কোর্সের মেয়াদ বৃদ্ধি ও কারিকুলাম বর্ধিত এবং আধুনিকায়ন করা তো অসম্ভব কিছু নয়। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা যা পড়ছে তা পড়েও দাখিল ও আলিমের শিক্ষার্থীরা তাদের মাদ্রাসা কারিকুলামের অতিরিক্ত বিষয়গুলোও পড়ছে। মেধা স্রষ্টা প্রদত্ত দান। আলিয়ার দাখিল ও আলিম পরীক্ষার সম্মান স্বীকৃতির সুযোগ থাকায় আলিয়া মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের অনেক শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করছে, মেধা তালিকায় উপরের দিকে থাকে বলে গণমাধ্যমে প্রায়ই খবর প্রকাশিত হয়। ঠিক অনুরুপভাবে ফাজিল ও কামিল কোর্সের পাঠদান ও কারিকুলাম মাদ্রাসার স্বাতন্ত্র্যবোধ বজায় রেখেও সংস্কার ও পরিধি বৃদ্ধি করে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি ও মাস্টার্সের পূর্ণাঙ্গ মানে উন্নীত করা যায়। এটা করা গেলে আলিয়া মাদ্রাসার অসংখ্য শিক্ষার্থী বাস্তব ও প্রায়োগিক বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাবে। তাদের মেধার পূর্ণ বিকাশ ঘটবে।
আলিয়া মাদ্রাসার অবস্থা যেমন তেমন হলেও কওমি মাদ্রাসার সামাজিক অবস্থা ও মান অনেক নাজুক ও করুণ। কওমি গন্ডির বাইরে তাদের সনদগুলোর কোন স্বীকৃতি নেই। ফলে প্রতি বছর কওমি মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে আসা লাখ লাখ কওমি শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কর্মকাণ্ডের বাহিরে রাখা হয়। অথচ তারাও বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের মৌলিক, সাংবিধানিক ও চাকুরির ক্ষেত্রে সমঅধিকার পাবার অধিকার আছে। এভাবে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে পাশ কাটিয়ে বা অবজ্ঞা করে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখলে তাদেরকে কায়েমি স্বার্থবাদি বা রাষ্ট্রদ্রোহি চক্র বা আধিপত্যবাদি শক্তি সহজ টার্গেট করতে পারে, করতে পারে তাদেরকে মিসগাইড। পতিত সরকার বিভিন্ন সময় তথাকথিত জঙ্গি তকমা লাগিয়ে নিরপরাধ কওমি শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও গুম করা আমাদের চোখের সামনে ভাসমান।
উন্নত বিশ্বের দেশ বৃটেনেও একাধিক শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে। মেইনস্ট্রীমের পাশাপাশি ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ক্যাথলিক স্কুল, ইসলামিক স্কুল, খ্রিষ্টান স্কুল ও ইহুদি স্কুলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাদের স্ব স্ব ধর্মের শিক্ষা কারিকুলামে থাকলেও মৌলিক কিছু বিষয় সব স্কুলের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা বা থাকা বাধ্যতামূলক। মৌলিক বিষয়গুলোর সার্বজনীন কারিকুলাম ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব স্কুল অনুসরণ করে বলে ঐ সব স্কুল থেকে জিসিএসই (এসএসসি সমমান) ও এ-লেভেল (এইচএসসি সমমান) পাশ করে মূল ধারার ইউনিভার্সিটিতে যেতে কোন অসুবিধা হয় না, হয় না কোন অসুবিধা সরকারি ও রাষ্ট্রীয় চাকুরী পেতে। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় নূন্যতম স্ট্যান্ডার্ড, গুনগত মান ও জাতীয় মূল্যবোধ নিশ্চিত করা হয়।
ঠিক অনুরূপভাবে, কওমি মাদ্রাসার কারিকুলামে সার্বজনিন মৌলিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে সিলেবাস ও পাঠদান আধুনিকায়ন করে প্রচলিত ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার মর্যাদা দেয়া যায় কি না সক্রিয়ভাবে ভেবে দেখা দরকার। এটি করতে পারলে কওমি মাদ্রাসার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে অনেকে সচিব, ডিসি এসপি হতে পারতো। বিষয়টি নি:সন্দেহে স্পর্শকাতর (sensitive)। উপর থেকে বা বাহির থেকে চাপালে হবে না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। পরিবর্তন আনতে হবে কওমি অঙ্গনকে নিজ থেকে, নিজের ভিতর থেকে। কওমি আলেম ও কওমি বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই এগুলো করাতে হবে। এটা করা গেলে লাভবান হবে লক্ষ লক্ষ কওমি শিক্ষার্থী। পাশাপাশি রাষ্ট্রও লাভবান হবে। আর এতে করে লক্ষ লক্ষ কওমি শিক্ষার্থীরা সরকারি ও রাষ্ট্রীয় কাজে আত্মনিয়োগ করে দেশ বিনির্মানে ও দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
লেখক : বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।




