‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নীতি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ৮:০২:৫৮ অপরাহ্ন
ফায়যুর রাহমান :
গাজার যুদ্ধবিরতির পর আবারও আলোচনায় এসেছে ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নীতি। বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ও গাজার যুদ্ধবিরতি আদতে ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নীতির একটি বাস্তব প্রয়োগ।
প্রিন্সিপল অব দ্য পিস থ্রো স্ট্রেংথ বা ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নীতির ধারনাটি এসেছে রোমান সেনাপতি ভেজেটিয়াসের লেখা থেকে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের আগে তিনি একটি কেতাব লিখেছিলেন : এপিটমা রেই মিলিটারিস। ‘যদি শান্তি চাও, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও’ কথাটি আসে এই ল্যাটিন কেতাব থেকে। শান্তি স্থাপনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কথাটা এনেছিলেন তিনি।
সেনাপতি ভেজেটিয়াস ছিলেন রোমান সমাজে একজন পেট্রিশিয়ান (অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তি)। পশ্চিমা সভ্যতায় তার কেতাবটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ‘সামরিক বাইবেল’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পরবর্তীতে অনেক চিন্তাবিদ ভেজেটিয়াসের ধারনাকে ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নামে ব্যবহার করেছেন। থিওডোর রুজভেল্ট এই ধারনাকে আরও জনপ্রিয় করেন ‘স্পিক সফ্টলি এন্ড ক্যারি এ বিগ স্টিক’ উক্তির মাধ্যমে। মানে ‘নরমভাবে কথা বলো, কিন্তু বড় লাঠি বহন করো’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের পরামর্শদাতা ছিলেন বার্নার্ড বারুচ। তিনিও একটি বই লিখেছেন ‘পিস থ্রো স্ট্রেংথ’ নামে। ১৯৬৪ সালের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীতেও এই নীতি প্রচারিত হয়েছিলো। ১৯৭০-এর দশকে এমএক্স ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণকে সমর্থন করতেও ব্যবহার করা হয় এই নীতি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র সঞ্চয়কে যুদ্ধের ডিটারেন্ট হিসেবে এই নীতিকে যুক্তিসঙ্গত বলে দেখানো হয়।
১৯৮০ সালে ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ ধারনাকে পুনরায় আলোচনায় আনেন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে এতটাই শক্তিশালী হতে হবে যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ শুরু করারই সাহস না পায়। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুর্বলতা দেখানোর অভিযোগ তুলে তিনি বলেন : ‘শান্তি নিজের ইচ্ছায় আসে না। এটি নির্ভর করে আমাদের ওপর। এটি গড়ে তোলা, রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হস্তান্তর করা নির্ভর করে আমাদের সাহসের ওপর।’
মূলত ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নীতি হলো- যে রাষ্ট্র নিজের সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সেই রাষ্ট্রই প্রকৃত শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম। মানে, তুমি যদি যথেষ্ট শক্তিশালী হও, কেউ তোমার ওপর আক্রমণ করবে না; ফলে শান্তি টিকে থাকবে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ ধারনা নানা রূপে হাজির হয়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ বড় দেশগুলো নিজেদের সামরিক সক্ষমতাকে ‘শান্তির নিশ্চয়তা’ হিসেবে উপস্থাপন করে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ও গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ আসলে ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ ধারনার একটি বাস্তব রূপ।
ট্রাম্প প্রশাসন গত মেয়াদে (২০১৭-২০২১) মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে কূটনীতি চালিয়েছিল, সেটি ছিল ‘শক্তি ও প্রভাবের মাধ্যমে চুক্তি’ (ডিল থ্রো ডোমিনেন্স) কৌশলের ওপর ভিত্তি করে। ট্রাম্প প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘আমেরিকা শক্তিশালী হলে শান্তি আসে’।
২০২০ সালে ট্রাম্পের যে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়, তার মূল কাঠামোতে ছিলো- ১. ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়া, ২. শর্তসাপেক্ষে ফিলিস্তিনিদের সীমিত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, ৩. আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ওপর জোর (যেমন ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’)। এই কৌশলের আসল কথা হলো- ইসরায়েল যদি সামরিকভাবে শক্তিশালী থাকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন পায়, তাহলে আরব দেশগুলো বাধ্য হয়ে ‘শান্তি’ মেনে নেবে। এটাই ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’র সরাসরি প্রয়োগ।
যখন ইসরায়েল-হামাস সংঘাত বৃদ্ধি পায়, তখন ট্রাম্প প্রশাসন সাধারণত ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়। কিন্তু পর্দার আড়ালে আবার মিসাইল হামলার চাপ, কূটনৈতিক হুমকি ও নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে পক্ষগুলোকে যুদ্ধবিরতিতে আনতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ শান্তির আহ্বান করা হলেও সেই আহ্বান শক্তির অবস্থান থেকে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বলে : ‘তুমি যদি এখন থামো, আমরা তোমার নিরাপত্তা নিশ্চিতে পাশে আছি’। আবার হামাসের দিকে যায় পরোক্ষ বার্তা : ‘আরও আগ্রাসন মানে বিধ্বংসী প্রতিশোধ’। এখানে শান্তির ভাষা ব্যবহার হলেও পেছনের প্রেরণায় ভয় ও ক্ষমতার ভারসাম্য। মানে ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’।
এ তো গেল ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ স্থাপনে শক্তিমানের প্রয়াসের কথা। কিন্তু দুর্বল রাষ্ট্রগুলো কী করবে? দুর্বল রাষ্ট্রগুলো কি ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নীতিতে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে পারবে? হ্যাঁ, পারবে। কীভাবে? সেটা দুই উপায়ে। এক উপায় নিজেরা শক্তিশালী হওয়া। পরমাণু সক্ষমতা অর্জন করা। এতে শান্তি টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেকাংশে রয়ে যায়। যেমন ভারত-পাকিস্তান দুই রাষ্ট্র পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের আগে যত যুদ্ধ ও সংঘাতে জড়িয়েছিলো, পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের পরে ততটা জড়ায়নি। হম্বিতম্বি করেছে, কিন্তু বড় সংঘাতে জড়ায়নি, শান্তিতে পৌছে গেছে। এর প্রধান কারণ উভয় রাষ্ট্রের পরমাণু সক্ষমতা। উভয় পক্ষই জানে তার প্রতিপক্ষ কতটা শক্তিশালী। ফলে শান্তি টিকে আছে।
উত্তর কোরিয়ার উদাহরণও দেওয়া যায়। উত্তর কোরিয়া পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের আগে যতটা নিষেধাজ্ঞা ও শান্তি ঝুঁকির মুখে ছিলো, পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের পরে ততটা নিরাপদ হয়ে গেছে। আফগানিস্তানের বেলাও এই উদাহরণ আনা যায়। সোভিয়েতবিরোধী দীর্ঘ লড়াই ও বিশ বছরের মার্কিন দখলদারী মোকাবেলা করার পর আফগানরা বিশ্বের কাছে পরোক্ষভাবে এই বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, ‘আমাদের ওপর আগ্রাসন চালাতে চাইলে হিসেব-কিকেশ করে এসো।’ ফলে ্ওখানে শান্তি টিকে থাকার সম্ভাবনা জাগ্রত।
বাকি রইলো অন্য গরিবরা। তারা কী করবে? তারা অবলম্বন করবে দ্বিতীয় পলিসি। তারা বহুপক্ষীয় অর্গানাইজেশন ব্যবহার করে ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ বাঁচিয়ে রাখবে। যেমন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আদালতের সাহায্যে বড় শক্তির একপক্ষীয় চাপ মোকাবিলা করবে। সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আদালত বা অঞ্চলিক সংস্থাকে কাজে লাগাবে।
সমষ্টিগত নিরাপত্তা ও ক্ষমতার ভারসাম্য ব্যবহার করতে পারে। ছোট রাষ্ট্রগুলো মিলে বড় শক্তির অতিরিক্ত চাপ মোকাবেলা করতে পারে, আওয়াজ উঠাতে পারে। যেমন সম্প্রতি রাশিয়ায় এক সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ একই সুরে বলে উঠেছিল : ‘বাগরাম ঘাঁটি দখলের অজুহাতে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চলবে না’। এটা একটা উদাহরণ।
দুর্বল দেশগুলো মেডিয়েটর বা মধ্যস্থতাকারী রূপে নিজেদের গড়ে তুলে অনেকটা ‘শান্তি’ বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এতে সামরিক শক্তি না থাকলেও মধ্যস্থতার মাধ্যমে কাতার বা নরওয়ের মতো আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিকতা বাড়ানো যায়।
যাই হোক, ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নীতি বাস্তবে শক্তিমানের হাতিয়ার হলেও দুর্বলরা এই নীতির সঙ্গে নিজেদের সংহত করতে পারে পরিকল্পিত কৌশলের মাধ্যমে। যদিও কে কোন কৌশল অবলম্বন করবে, সেটা তার এখতিয়ার।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।




